×

মুক্তচিন্তা

পারুলের জন্য ‘নারী-দেয়াল’ হয় না?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম

পারুলের জন্য ‘নারী-দেয়াল’ হয় না?
পারুলের জন্য ‘নারী-দেয়াল’ হয় না?

ভারতের কেরালার মেয়েরা ৬২০ মিটার ‘নারী-দেয়াল’, মানে মানববন্ধন বা নারীবন্ধন করে বিশ্বময় আলোড়ন তুলেছেন। আমাদের মেয়েরা সুবর্ণচরের ধর্ষিতা পারুলের জন্য কয়েক মিটার ‘নারী-দেয়াল’ তুলতে পারেন না?

পূর্ণিমা রানী শীল তার ওয়ালে লিখেছেন, ‘পূর্ণিমার রক্ত শুকিয়ে গেছে, পারুলের রক্ত শুকায়নি, শুকাতে দিও না। থেমে যেতে দিও না, যুদ্ধ করো, পাপীকে শাস্তি দাও’। তিনি লিখেছেন, ‘আমার রক্ত, পারুলের রক্ত, আপনার রক্ত একই; অপশক্তিকে বাড়তে দিও না। নারী তোমরা কই, আছো, না আমার মতো হেরে গেছো’? পূর্ণিমা নারীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, বলেছেন, ‘নারী পারে’- যেমন পারছেন শেখ হাসিনা।

এই পূর্ণিমা উল্লাপাড়ার। যার মা বলেছিল, ‘বাবারা আমার মেয়েটা ছোট, একজন একজন করে যাও’। পারুল নোয়াখালীর সুবর্ণচরের, চার সন্তানের জননী। ধর্ষিতা হওয়ার আগে আকুতি করেছিলেন, ‘আমাকে নষ্ট করো না, আমার সন্তানরা আমায় মা বলে ডাকবে না’। ধর্ষক পূর্ণিমার মা বা পারুলের আকুতি শোনেনি। নির্বাচন-উত্তর তা-বে গণধর্ষিতা হয়েছেন দুই নারী। এ দুজন প্রতীক মাত্র, ধর্ষিতা অগণিত। ধর্ষিতা দেশমাতৃকা।

নৌকায় ভোট পূর্ণিমার কপাল পুড়েছে। ধানের শীষে ভোট পুড়ল পারুলের কপাল। আগে যুদ্ধজয় হলে নারী ধর্ষিতা হতেন? এখন নির্বাচনে জয়ীরা ধর্ষণ করেন। ২০০১-এর পর অসংখ্য রমণী ধর্ষিতা হয়েছেন। জনকণ্ঠ পত্রিকা হেডিং করেছিল, ‘এক রাতে এক জায়গায় ২০০ রমণী ধর্ষিতা’। পত্রিকাটি ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ বলেছিল, ধর্ষিতাদের ৯৮.৭% হিন্দু। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন কমিশন পাঁচ হাজার ঘটনা বিচারের সুপারিশ করেছিল, বিচার হয়নি।

পূর্ণিমা বিচার পেয়েছে। যদিও অভিযোগ আছে, তার ধর্ষকরা কেউ কেউ প্রকাশ্যে? বাদবাকি অগণিত ধর্ষিতা বিচার পায়নি। কীর্ত্তিকা ত্রিপুরা ধর্ষণের বিচার চেয়ে তাই লজ্জা দেবেন না? ২০০১-এর ঘটনারও বিচার হয়নি। তবে দুটি ঘটনার তফাৎ আছে। তখন ধর্ষণ ছিল সরকারি ছত্রছায়ায়। ওরা বিচার করেনি, প্রশ্রয় দিয়েছে। পূর্ণিমাও তখন বিচার পায়নি। পারুলের বিচার সরকার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে শুরু করেছে। দলীয় নেতাকে অভিযোগ থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বা এখনো আছে, কিন্তু শেষরক্ষা হবে বলে মনে হয় না?

এই ঘটনার পর একাত্তর টিভিতে এক টকশোতে স্থানীয় সাংবাদিক জানাচ্ছিলেন যে, পুলিশের বড় কর্মকর্তারা তাদের বলেছেন, এই ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাই কেউ ছাড়া পাবে না। সাদামাটা স্টেটমেন্ট, তবু কানে লেগেছে। কারণ পুলিশ তৎপর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে, পারুল গণধর্ষিত হয়েছে বলে নয়? সমস্যাটা এখানে, ধর্ষণকে পুলিশ প্রশাসন প্রায়শ তেমন গুরুত্ব দেয় না। সমাজ কি খুব একটা গুরুত্ব দেয়? নাকি ধর্ষণের নানান কারণ খুঁজে বেড়ায়, এমনকি ধর্ষিতার পোশাকও গুরুত্ব পায়?

পারুলের স্বামীর একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আমি অশিক্ষিত মানুষ, থানায় গিয়ে সব কথা খুলে বলেছি, তারা কেন দলীয় নেতার নাম এজাহারে লিখেনি জানি না’। উপরের দিকে আঙুল তোলার আগে এটি বুঝতে হবে, সমস্যা স্থানীয়, থানা তো বটেই। লোকে বলে, থানা চাইলে সমাধান করতে পারে না, এমন কোনো সমস্যা নেই? পুলিশের কমন ডায়ালগ, ‘উপরের নির্দেশ’ তো আছেই? পুলিশ বিভাগের উচিত, অন্তত খুন ও ধর্ষণ, এই দুটি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেয়া?

সামাজিক মাধ্যম এই ঘটনার চমৎকার ভূমিকা পালন করেছে। মিডিয়া এগিয়ে আসে। বামপন্থি কিছু সংগঠন প্রতিবাদ করেছে। কিছু মহিলা সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। সরকার এগিয়ে এসেছেন। বড় বড় দলগুলো আরো এগিয়ে আসতে পারত। নারী নেত্রীরা ঠিক ততটা সরব নয়? যারা নারী সাংবাদিকের চরিত্র রক্ষায় সভা-সমিতি করেছেন, তাদের ধর্ষিতা পারুলের জন্য মাঠে দেখা যাচ্ছে না? কারণ, পারুল গরিব, সবার ভাবী?

ভারতের কেরালার মেয়েরা ৬২০ মিটার ‘নারী-দেয়াল’, মানে মানববন্ধন বা নারীবন্ধন করে বিশ্বময় আলোড়ন তুলেছেন। আমাদের মেয়েরা সুবর্ণচরের ধর্ষিতা পারুলের জন্য কয়েক মিটার ‘নারী-দেয়াল’ তুলতে পারেন না? স্থানীয় এমপি শপথ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন? সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই? ধর্ষকেরও কোনো দল নেই? ধর্ষক কারো ভাই-বন্ধু, স্বামী-পুত্র, কর্মী হতে পারে না। ধর্ষকের পরিচয়, শুধুই ধর্ষক। ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ, ধর্ষকের স্থান জনারণ্যে নয়, কারাগারে।

শিতাংশু গুহ : নিউইয়র্ক থেকে, কলাম লেখক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App