×

মুক্তচিন্তা

খুব তৃষ্ণা পেয়েছে যে, এক ঢোক সত্য পান করার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:২৮ পিএম

খুব তৃষ্ণা পেয়েছে যে, এক ঢোক সত্য পান করার!
খুব তৃষ্ণা পেয়েছে যে, এক ঢোক সত্য পান করার!

তথ্য গোপন করে কাউকে আশ্বস্ত করা কঠিন প্রহসন। যদি দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বা বিভাগ এই কাজটি করেন, তাহলে তা হয় পরাধীনতারই পুনরাবৃত্তি। বেশি অবাক হয়েছি, এমন একটি বিষয় নিয়ে টিভি টকশোতে আলোচনা হতে না দেখে। সুশীল বলে খ্যাত বুদ্ধিওয়ালা শ্রেণির নীরবতা পালন দেখে। পরিশেষে বলি, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সঠিক তথ্য নিয়ে এগুতে হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবার চেষ্টা, রীতিমতন ধৃষ্টতা। যা একটি রাষ্ট্রে সুশাসন ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয় না। আর জন্ম, প্রতিটি মৃত্যুকে নিশ্চিত করলেও, তা যেন হয় স্বস্তিকর। অনাকাক্সিক্ষত যেন না হয়।

‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এই বচনকে অগ্রাহ্য করার সাধ্যি কার। কারোর নেই। কারণ জগতে যে জন্মেছে, তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রাণ যার আছে, সেইই মরে। প্রতিটি প্রাণী এই অমোঘ সত্যে আবর্তিত, নিমজ্জিত। মানুষ প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সত্য বেশি দৃশ্যমান।

মানুষ তার জীবন-যাপনে যত আয়োজনমুখী হয়, হতে হয়, সম্ভবত অন্য প্রাণীদের সে সবের আয়োজন পড়ে না। তাই চোখে পড়ে না। নিজহাতে গড়া সব প্রাচুর্য, স্থাপনা, সম্পর্ক ছেড়ে বিদায় নেয়ার মর্মান্তিক দৃশ্য, শূন্যতা, হাহাকার এসব ঘটনা মানুষের। আবার মানবজগতের খবর ছাড়া মানুষ অন্য জগতের খবর জানে না, রাখে না বলেই রাখার প্রয়োজন হয় না।

প্রাণিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ, আগ্রহীদের কথা বাদ। তারা প্রাণিসম্পদ রক্ষায়, সংরক্ষণে জ্ঞান আহরণ করেন। গবেষণা করেন। তারা বলেন, প্রাণিসম্পদ রক্ষা দরকার এ কারণে যে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য তথা পৃথিবীর অস্তিত্ব রক্ষায় এটা অত্যন্ত জরুরি, অপরিহার্য। গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সভা-সেমিনার, ওয়ার্কশপ বাস্তবায়ন করেন। নিজেরা বুঝে অন্যদের বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, জীবচক্রের গুরুত্ব কতটা অর্থবহ। এসব জায়গায় সমাজ আর রাষ্ট্রের বড় বড় মাপের ব্যক্তিরা উপস্থিত হন। সহমত প্রকাশ করেন। আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, ধন্য হন। ঘোষণা আসে, এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আরো অর্থের বরাদ্দ করা হবে, বরাদ্দ হয়।

এই পৃথিবীতে কতরকম প্রাণী আছে, আমার মতন অতি ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়, জানাও নয়। তার ওপর প্রাণী বিশেষজ্ঞ নই। শুধু এটুকু বুঝি, আমার মানবজগতে বাস মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ায়। সেই অর্থে একজন মানুষ। জন্ম, মৃত্যুকে নিশ্চিত করলেও, মৃত্যু বিষয়টি কোনোভাবে, কোনো কারণেই ভালো লাগে না। মনে হয় যেতে হবে, তাই বলে কেনো নিছক এই আসা। এ এক প্রহসন মনে হয়। মানুষের জন্য আপসহীন শাস্তি মনে হয়। আমার মনে হওয়ায় সৃষ্টিকর্তার কিসসু যায় আসবে না, সেও জানি।

তিনি তার খেলায় মত্ত আছেন, থাকবেন। যাই হোক। যেখানে চলে যাওয়া মানা কঠিন, সেখানে চলে যাওয়া যদি আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত, মর্মান্তিক হয়, হয় বড্ড অব্যবস্থাপনার, অবহেলার, তাহলে তো আর কথাই নেই। মানা কঠিন হয়ে যায়, এমন মৃত্যু, জীবনের সব আয়োজন পেছন ফেলে ফিরে যাওয়া। মৃত্যুকে মেনে নিতে ইচ্ছে হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে মেনে নিতে পারি না।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি -২০১৮’, সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনটি সরকারি-বেসরকারি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

যেখানে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এই প্রতিদেনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালেই বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মারা গেছে।

এই সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ২১ হাজার ৩১৬ জন মারা গেছে। চার বছরের ব্যবধানে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৬৩৮ জন। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু ও বেড়ে যাওয়া মৃত্যুর হার যতটা না পীড়া দেয়, বেদনাহত করে, ব্যথিত করে, তার শতগুণ বেশি অবাক করে দেয়, নির্বাক করে দেয়, লজ্জিত করে দেয় সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সরকারি হিসাবটা।

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত যে, বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৭৬ জন। আর ২০১২ সালে মারা গেছে ২ হাজার ৫৩৮ জন। অর্থাৎ সরকারি হিসাবে দেখানো হয়েছে বিগত চার বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে ১৬২ জন!

অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি হিসাবের চাইতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১০ গুণ বেশি। এ কি কাণ্ড! ভৌতিক কিছু নয় তো! হিসাবটা আকাশ-পাতাল কেন? একে তো সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১০ গুণ কম দেখানো হয়েছে, তার ওপর বছরপ্রতি ক্রমশ কমছে, তেমনই হিসাব দেখানো হয়েছে। ব্যাপারটা কেমন যেন, না?

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি হিসাবের এই বিশাল তারতম্য অনেক প্রশ্নের অবতারণা করে, প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমাদের হতাশ করে। ভীত করে। নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে নিরুৎসাহিত করে। ভাবি, যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য সঠিক হয়, তাহলে তো সরকারি হিসাবকে মিথ্যে ভাবতে হয়। ভাবতে হয়, সরকারের তথ্য গোপনের পাঁয়তারার ফল এটা।

সরকার চাইছে না, প্রকৃত তথ্য জনগণ জানুক। জানলে সমস্যা। ব্যর্থতা কথা প্রকাশ পাবে ওতে। তাই কী? নাকি সরকারের পক্ষে কেউ আছেন যিনি এই প্রতিবেদনের সমুচিত একটা জবাব দিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করবেন যে, সড়কের নিরাপত্তায় তারা একনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ এবং তারাই সত্যটা বলছেন? খুব তৃষ্ণা পেয়েছে যে, এক ঢোক সত্য পান করার! সত্যের যে কোনো বিকল্প নেই আস্থা আর ভরসার জন্য।

এ প্রসঙ্গে একটি জাতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক, যিনি সড়ক নিরাপত্তার বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, সারাদেশে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার সব খবর পুলিশের কাছে আসে না। পুলিশও সব খবরকে গুরুত্ব দেয় না। ফলে সরকার যদি পুলিশের প্রতিবেদন ধরে মনে করে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু কমেছে, তাহলে সেটা ভুল পথে হাঁটা হবে। ঠিকই তো। কিন্তু এই সত্য বুঝবার জন্য কে আছে দায়িত্বে, জানতে ইচ্ছে করছে। মাত্র কিছুদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অভূতপূর্ব, নির্মল এক আন্দোলন হয়ে গেল। সড়ক দুর্ঘটনায় সহপাঠীদের মর্মান্তিক মৃত্যু ছিল এই আন্দোলনের সূচনা। সড়কে যেন কারোর মৃত্যু না হয়, সেই দাবিটাই ছিল আন্দোলনের পরতে পরতে।

এই আন্দোলন আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের ব্যর্থতার করুণ চিত্র। একজন মন্ত্রী কীভাবে ব্যঙ্গ অভিব্যক্তিতে মৃত্যুকে তাচ্ছিল্য করতে পারে, তাও দেখালো। শিশু-কিশোররা দেখালো বিচারপতি, মন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে কেউ বাদ পড়েনি শৃঙ্খল হয়ে আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে। আহা! কত অনিয়ম এসব বিজ্ঞজনের ভেতর! কী নিয়ম ভঙ্গ করে চলাচল! তাদের অনেকেই বৈধ কাগজপত্র ছাড়া রাস্তায় গাড়িতে চলাচল করেন। বাচ্চারা পথে নেমে দেখিয়েছে, শৃঙ্খলা কী। কীভাবে চলতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জীবননাশক রাজনীতি এই আন্দোলনের শ্বাসরোধ করেছে। আমরা দেখেছি, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলনকে নিজেদের দুর্গন্ধময় ঝুলিতে ভরতে রাজনৈতিক দলের অপতৎপরতা।

শিশু-কিশোরদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনকে সরকার সাদুবাদ জানিয়েছে, মেনেছে। আন্দোলনের শেষের দিক সুখকর না হলেও কিছু কিছু বিষয়ে ভেবে নিয়েছি, হয়তো নিরাপদ সড়ক দৃশ্যমান হবে। শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলন ছিল অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ জনকল্যাণমুখী।

সুতরাং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকারের কোনো বাধা নেই, অহেতুক মাথাব্যথার সম্ভাবনা নেই। বেপরোয়া পরিবহন শ্রমিকের নেতা যত বড় মন্ত্রীই হন কেন, সড়ক নিয়ন্ত্রণ করুন না কেন, সরকারের ভেতর এমন বেসামাল মন্ত্রীই তো কেবল একজন মন্ত্রী নন। সামাল মন্ত্রীরা আছেন, আমলারা আছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছেন। এমন অবস্থায় একটা সড়ক আইনও পাস হয়েছে। সুতরাং নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন দেখা যায়।

কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি -২০১৮’ রিপোর্ট এমন স্বপ্ন দেখতে ভীত করে, নিষেধ করে। কার ওপর আমাদের আস্থা হারায়, বুঝি কী তা? সঠিক তথ্য না জানলে, না প্রকাশ করলে, সমস্যার সমাধান হয় না, হয়নিও কোনোদিন। তথ্য গোপন করে কাউকে আশ্বস্ত করা কঠিন প্রহসন। যদি দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বা বিভাগ এই কাজটি করেন, তাহলে তা হয় পরাধীনতারই পুনরাবৃত্তি।

বেশি অবাক হয়েছি, এমন একটি বিষয় নিয়ে টিভি টকশোতে আলোচনা হতে না দেখে। সুশীল বলে খ্যাত বুদ্ধিওয়ালা শ্রেণির নীরবতা পালন দেখে। এমন অনেক সাংবাদিক, লেখক আছেন, যারা অভিনয় শিল্পীদের সঙ্গে আড্ডায় তাদের পারিবারিক বা দাম্পত্য জীবনের খোশগল্পে জীবনের ভাষা খোঁজেন, রস পান করেন, তারা ভুলেও নিরাপদ সড়কের মর্মান্তিক মৃত্যুতে মর্মাহত হন না। জীবনের মানে খুঁজে ফেরেন না। হতাশ হই।

পরিশেষে বলি, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সঠিক তথ্য নিয়ে এগুতে হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবার চেষ্টা, রীতিমতন ধৃষ্টতা। যা একটি রাষ্ট্রে সুশাসন ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয় না। আর জন্ম, প্রতিটি মৃত্যুকে নিশ্চিত করলেও, তা যেন হয় স্বস্তিকর। অনাকাক্সিক্ষত যেন না হয়। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিবেদনের একটি সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া আশা করছি সরকারের কাছ থেকে।

স্বপ্না রেজা: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App