×

মুক্তচিন্তা

নিশ্চিত সরকার গঠন এবং উত্তাপহীন নির্বাচন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০১ পিএম

এ নির্বাচনে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দেশ চালনায় আসবে, না-কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ গ্রুপের সহায়তাকারীরা আসবে- এ ইস্যুটা উচ্চারিত হওয়াটা যৌক্তিক। এটা হতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের ভিত্তির একটা সুদৃঢ় জায়গা আছে। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, লাখ লাখ মানুষের আত্মদান সর্বোপরি স্বাধীনতার চেতনা লালন করে যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির শিখরে, দেশ চালনায় আমরা তাদেরই দেখতে চাই।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, আওয়ামী লীগ অর্থাৎ মহাজোট সর্বোচ্চ ২২২টি আসন পেতে পারে। স্বাভাবিকভাবে এ রকম আসন পেয়ে গেলে মহাজোটই আবারো সরকার গঠন করবে। যেহেতু তিনি সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন এবং এখনো তার দলের হয়ে নির্বাচন নিয়ে তথ্য-তালাবি নিচ্ছেন, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই জয়ের এ তথ্য অনুমান নির্ভর নয়।

অন্যদিকে বিভিন্ন জরিপে আওয়ামী লীগ কিংবা মহাজোট আবার যে ক্ষমতায় আসছে এ আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বাইরের প্রায় প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। দুয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচন নিয়ে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সহিংস ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগের দুজন কর্মী নিহত হওয়াসহ বিএনপিরও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

এভাবেই নির্বাচনী হাওয়া আওয়ামী লীগের অনুকূলেই আছে বলে ধারণা করা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। বিশেষত বিভিন্ন জায়গায় গ্রেপ্তার-ধরপাকড় নির্বাচনের গোটা আমেজকে একটা অস্বস্তিতেই ফেলে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষত কোনো কোনো প্রার্থীকে হঠাৎ করে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এদের অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা ঝুলানো ছিল এবং সে জন্য গ্রেপ্তারের জন্য নতুন করে কোনো প্লট তৈরি করতে হচ্ছে না। কিন্তু এই প্রার্থী কিংবা ছোটখাটো নেতাকর্মীদের এখন আটক না করলেই কি হতো না। সারাদেশের জেলা-উপজেলায় এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও গ্রেপ্তারি আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট লাগাতার অভিযোগ করছে।

দেখা যাচ্ছে, গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেরই নামে আগেও মামলা ছিল। যেহেতু এদের নামে আগেও মামলা ছিল, সেহেতু নির্বাচনী ডামাডোলের আগেই এদের গ্রেপ্তার করাই প্রয়োজন ছিল। নির্বাচনকে সামনে রেখে এদের গ্রেপ্তার করা হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধই হতেই পারে। সরকারের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান, নির্বাচন কমিশন নিয়ে যাদের সমালোচনা অর্থাৎ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কিংবা বামজোট এটাকে অবধারিত এক ইস্যু হিসেবেই জনসমক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে কিংবা করছে।

‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩০০ আসনেই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে’ বলেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সচিব রুহুল কবির রিজভী। ৩০০ আসনে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর আমরা না খুঁজলেও এটাই সঠিক হামলার ধরন-ধারণ খুব একটা সুবিধার নয়। এমনকি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী জলি তালুকদারের নির্বাচনী মিছিলে হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে নেতাকর্মীদের। জলি নিজেও আহত হয়েছেন।

এ হামলার জন্য জলি দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। সারাদেশের হাতেগোনা দুয়েকটা জায়গার মাঝে এ আসনটিতে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ভালো লোক জমায়েত হচ্ছে। নেত্রকোনার এই একটা সংসদীয় এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির একটা শক্ত অবস্থান। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আরো দুজন নারী নেত্রীর সঙ্গে জলি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলা থেকে শুরু করে ড. কামাল হোসেন কিংবা জলি তালুকদারের ওপর হামলা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না এবং প্রকারান্তরে এই দায়ভার পড়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ওপর।

অর্থাৎ সমালোচনার সম্মুখীন হতেই হচ্ছে তাদের। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের পরোক্ষ সমর্থন দিলেও সর্বক্ষেত্রেই শৈথিল্য দেখাবে, তা নয়। ড. কামালের ওপর আক্রমণ রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছে। অনেকেই বলতে পারেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেই নির্বাচনের হেরফের কিছু হবে না কিংবা সরকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সদিচ্ছার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।

ঢাকা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচনী উত্তাপ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভায় লাখো জনতার উপস্থিতির বিপরীতে ঐক্যফ্রন্টের সভা-সমাবেশ নিষ্প্রভ। স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র হতে পারতেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের মতো মির্জা ফখরুল বলি কিংবা ড. কামাল হোসেন বলি কেউই জনগণের কাছে আসতে পারছেন না, পারবেনও না। সে জন্য নির্বাচনী আমেজ কিছুটা হলেও ম্লান। উদ্যম নেই। বিএনপির মাঝে আছে হতাশা।

নির্বাচনকে যেভাবে একটা জাতীয় উৎসবমুখর আয়োজন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল, যেভাবে নির্বাচনকে সব জনগণের অংশগ্রহণের একটা প্লাটফর্ম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা ছিল, লাগাতার হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে সে আয়োজন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, নির্বাচনকালীন হামলা হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু বারবার হামলা ওই ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটার গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে। ড. কামাল, মির্জা ফখরুল, জলি তালুকদার কিংবা অন্যান্য প্রার্থী কিংবা নেতাকর্মীর ওপর এ হামলার কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকার কথা নয়।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সবাই-ই বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ভয়ে অযথা এই দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছে তাদের ওপর। সে জন্যই বলতে হয় যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ, সেখানে দলটির পক্ষ থেকে হামলা নিয়ে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে। অহেতুক কেন এই দায় নিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।

ড. কামাল কিংবা মির্জা ফখরুলের ওপর হামলাগুলো উঠে আসার বিভিন্ন কারণ আছে। এরাই বাংলাদেশের জাতীয় নেতাদের একেকজন। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে দেশের জনগণ এই হামলাগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে নেবে। এ হামলাগুলোকে প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে জনমনে আশঙ্কা কিংবা ভীতি কাজ করাটা অযৌক্তিক হবে না। ভীতি থাকতেই পারে নির্বাচন নিয়ে।

দেশব্যাপী যদি এ রকম একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যায় যে, এ নির্বাচনের প্রচারণায় ঐক্যজোটের নেতারাও নিরাপদ নন, তাহলে ভোটগ্রহণের দিন মানুষের উপস্থিতি হ্রাস পাওয়াটা স্বাভাবিক। দশ বছরের পরে ভোটের সুযোগ পাওয়া মানুষগুলোর কাছে নির্বাচন শুধু শুধু কেন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, সে প্রশ্নটা আসতেই পারে।

এ ছাড়া মাঠের জরিপে যেহেতু আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে, সেহেতু সহিংসতা প্রতিরোধের ব্যাপারে কর্মীদের আরো একটু কঠোর নিদের্শনা দিয়ে রাখাটাই তো যুক্তিযুক্ত। এ নির্বাচনে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দেশ চালনায় আসবে, না-কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ গ্রুপের সহায়তাকারীরা আসবে- এ ইস্যুটা উচ্চারিত হওয়াটা যৌক্তিক। এটা হতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের ভিত্তির একটা সুদৃঢ় জায়গা আছে। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, লাখ লাখ মানুষের আত্মদান সর্বোপরি স্বাধীনতার চেতনা লালন করে যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির শিখরে, দেশ চালনায় আমরা তাদেরই দেখতে চাই। আমরা চাই না সেই পরাজিত শত্রুদের গাড়িতে আবারো জাতির পতাকা উড়ুক।

এ জাতি চায় না এ দেশে আবারো গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত মানুষের ছিন্নভিন্ন লাশ, এ দেশ চাইতে পারে না আবারো ২১ আগস্ট আসুক, এ দেশ চায় না উদীচী-কমিউনিস্ট পার্টি-বাংলা একাডেমি-আদালত প্রাঙ্গণে আবারো রক্ত প্রবাহিত হোক। ‘বাংলা ভাই’ নামক ভয়ানক খুনিদের থাবার কাছে নতি স্বীকার করুক বাংলাদেশ। এ দেশ চাইতে পারে না আগুনের সন্ত্রাস। ঠিক সেভাবেই আমরা চাইতে পারি না, ইয়াবা ব্যবসায়ীর স্পর্শে কলঙ্কিত হোক সংসদ নামক পবিত্র স্থান, জনগণ চাইতে পারে না বহু উচ্চারিত সন্ত্রাসীরা ক্ষমতার অংশীদার হোক।

একাত্তরের রক্তস্নাত বাঙালি জাতির চেতনা, সেই চেতনা ধারণ করা বাংলাদেশের নাগরিকরা চাইতেই পারে না সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতার পাশাপাশি থাকুক, ভোট ব্যাংকের হিসাব দেখিয়ে একাত্তরের যে কোনো পরাজিত শত্রু সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলে আমাদের না বলতেই হবে ৩০ তারিখের নির্বাচনে।

লন্ডন থেকে ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App