×

মুক্তচিন্তা

মুক্তিযুদ্ধে মেঘালয়ের সাধারণ মানুষের ভূমিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:১৩ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে মেঘালয়ের সাধারণ মানুষের ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধে মেঘালয়ের সাধারণ মানুষের ভূমিকা

শরণার্থীদের সহায়তার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল মেঘালয়ের সাধারণ মানুষরা। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন যুদ্ধ করার প্রেরণা। এ ছাড়া মেঘালয়ের জোয়াই মহকুমার জুরাইন এলাকায় মফিয়েট নামক স্থানেও গড়ে উঠেছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় রাজ্য। একদিকে আশ্রয় দিয়েছে বিপুল শরণার্থীকে, অন্যদিকে মেঘালয় পরিণত হয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণের অন্যতম কেন্দ্রে। সীমান্তবর্তী এই মনোরম রাজ্যটি বহুমুখী সম্পৃক্ততায় একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সীমান্তবর্তী অন্য রাজ্যগুলোর মতো মেঘালয়ের সাধারণ নাগরিকরাও সম্পৃক্ত হয়েছিল এই প্রক্রিয়ায়।

একাত্তরে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের উত্তর দিকের মানুষ জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন মেঘালয়ের পাহাড়গুলোতে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে শরণার্থী ক্যাম্প। বাংলাদেশকে ঘিরে রাখা ভারতের অন্য প্রদেশগুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন মেঘালয়। এটা খাসিয়াদের রাজ্য, যার সঙ্গে বাঙালিদের ভাষা ও আচরণগত ফারাক অনেক। এরপরও উদ্বাস্তু শরণার্থীদের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছিল স্থানীয় খাসিয়ারা।

একাত্তরে শিলংয়ে অক্সফাম জিবির এক সুইডিশ কর্মকর্তা শরণার্থী সহায়তায় কাজ করতেন। তার টিমে একাত্তরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন স্থানীয় তরুণ অমর সিংহ। বলছিলেন সেই অস্থির সময়ের কথা।

‘শুধু বাঙালিরা নয়, অনেক আবাঙালি ভারতীয়রাও সাহায্য করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে, শীতের সময় বাঙালি-অবাঙালি সবাই মিলে শীতের পোশাক, কম্বল দিয়ে শরণার্থীদের সহায়তা করেছিল, ট্রাক ভর্তি করে সেসব মালামাল আমি নিয়ে যেতাম ক্যাম্পে।’

মেঘালয়ের বালাট ও ডাউকি একাত্তরে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম কেন্দ্রে। এই দুটি সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেছিল এপ্রিলের শুরু থেকে। একাত্তরে বাংলাদেশের সমর্থনে মিছিল, মিটিং এ মুখর ছিল মেঘালয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে, শরণার্থীদের সহায়তায় শিলং, ডাউকি, বালাটে পালন করা হয়েছে বনধ, অবরোধ, অনশন।

১ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও বর্বরতার প্রতিবাদে শিলংয়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করেন। প্রতিদিন মাথায় পুঁটলি নিয়ে দলে দলে নারী-পুরুষ আসছে অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, নেই বাসস্থান। ভুগছে কলেরাসহ নানা অসুখে। ‘এসব দেখে আমি আর থাকতে পারলাম না। মানুষের এত কষ্টে, ছোট ছেলেমেয়ে রেখে প্রতিদিন ছুটতাম শরণার্থী শিবিরের দিকে। ইচ্ছা ছিল, যদি একটু সহযোগিতা তাদের করা যায়।’

একাত্তরের স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন অঞ্জলি লাহিড়ী। একাত্তরে মেঘালয় রাজ্যে শরণার্থী সহায়তায় যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অঞ্জলি লাহিড়ীকে নিয়ে শাহীন আখতার লিখছেন, ‘একাত্তরের প্রতিটি স্মৃতিকথায়, যেখানে মেঘালয় সীমান্তের কথা আছে, অঞ্জলি লাহিড়ী সেখানে এসে যান অবিচ্ছেদ্যভাবে।’ শরণার্থীদের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। শিলংয়ের এই মহীয়সী নারী পাহাড়ের পাদদেশে সেলা, আমলারেং, পান্তুং, ডাউকি, ওয়ারেংকা, বালাট, বড়ছড়া ঘুরে বেড়িয়েছেন।

শরণার্থীর শোকে-দুঃখে একাত্ম হয়েছিলেন। নিজ চেষ্টায় সংগ্রহ করেছেন ত্রাণসামগ্রী, কাপড়চোপড় ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। যোগাযোগ করেছেন রেডক্রস, অক্সফামের সঙ্গে। এসেছেন মাইলাম। দেখেছেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মানুষের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। মানবতার এমন বিপর্যয় আগে কখনো দেখেননি। সেই স্মৃতি লিখছেন অঞ্জলি নিজেই, ‘ঘুমন্ত সেলা আবার জেগে ওঠে। জেগে ওঠে বিগত শতাব্দীর রণক্লান্ত সেলা। মর্টার আর সেলের শব্দে, বারুদের গন্ধে তার ঘুম ভেঙে যায়। এবারকার নায়ক ডেভিড স্কট আর তিরতসিং নয়। আজকের নায়ক একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাতক রাজশক্তি, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমগ্র মুক্তিকামী জনসাধারণ।’

প্রীতিরানী দাশ পুরকায়স্থ শরণার্থী মহিলাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা মুক্তিফৌজ সহায়ক সমিতি। সভানেত্রী হিসেবে তিনি কাজ পরিচালনা ও তদারকি করতেন। সহসভাপতি গীতারানী দাস, সম্পাদক নিবেদিতা দাস। তাদের চেষ্টায় একটি প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সুধা কর, প্রমিলা দাস, শক্তিদেবী, মঞ্জু দেবী, সুমতি দেবী, গায়ত্রী তরফদার, বাসন্তী আচার্য্য ও রমা দাসসহ অনেক মহিলা এ সমিতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। কেউ ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে শরণার্থীদের সেবা-শুশ্রুষায় নিবেদিত। কেউ ধাত্রী প্রশিক্ষণ, নার্স প্রশিক্ষণ নিয়ে শিবিরে এবং মুক্তাঞ্চলে কাজ করছেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সেবা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন কয়েকজন।

শরণার্থীদের সহায়তার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল মেঘালয়ের সাধারণ মানুষরা। একাত্তরে মেঘালয়ের তুরা, ডাউকিতে গড়ে উঠেছিল বড় দুটি প্রশিক্ষণ শিবির। মেঘালয়ের সাধারণ লোকজন সেসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীদের সহায়তা ও সেবায় সম্পৃক্ত করেছিল নিজেদের। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন যুদ্ধ করার প্রেরণা।

এ ছাড়া মেঘালয়ের জোয়াই মহকুমার জুরাইন এলাকায় মফিয়েট নামক স্থানেও গড়ে উঠেছিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। সেখানেও স্থানীয় গ্রামবাসীরা নানাভাবে সহায়তা করতেন। যদিও এটি খাসিয়া অধ্যুষিত ছিল, এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুর্খা রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রাথমিকভাবে ভারতে ছয়জন জ্যাকপট কমান্ডারের অধীনে যে ছয়টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল তার একটি মেঘালয়ের তুরা।

অঞ্জলি লাহিড়ীর স্বামী নীরেন লাহিড়ীও নীরবে সহায়তা করেছেন শরণার্থীদের। তিনি তখন মেঘালয়ের এডভোকেট জেনারেল। অঞ্জলি লাহিড়ীর সঙ্গে কাজ করেছেন আশরাফি বেগম। আশরাফি ছিলেন আহমদ হোসেন ও আফজাল হোসেনের বোন।

মূলত বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো কাপড়, শীতবস্ত্র কিংবা নগদ অর্থ সংগ্রহ করতেন তিনি। অঞ্জলির সঙ্গে ঘুরেছেন অনেক শরণার্থী ক্যাম্পে। জোছনা বিশ্বাস ছিলেন অঞ্জলির আরেকজন সহকর্মী। আশরাফি বেগমের মতো তিনিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতেন, বিভিন্ন ওষুধের দোকানে গিয়ে সংগ্রহ করতেন ওষুধ।

অঞ্জলি লাহিড়ী চট্টগ্রামে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমাকে বলছিলেন, ‘আমি, আশরাফি ও জোছনা মিলে কলেরা ও রক্ত আমাশয় আর শরণার্থীদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।’

ভয়াবহ কলেরা মহামারী, সঙ্গে জয় বাংলা নামক চোখ ওঠা রোগের তাণ্ডব। মেঘালয়ের আদিবাসীরা ভীত শরণার্থীদের এসব রোগে। মহামারি ছড়ানোর শঙ্কায় শিলংয়ে শরণার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। বিদেশি দাতা সংস্থার সদস্য, চিকিৎসক সবাই সর্বোচ্চ সতর্ক যাতে নিজেরা আক্রান্ত না হয়। কিন্তু অঞ্জলি কিংবা সাধারণ মেঘালয়বাসীরা কীভাবে নিয়েছিল সে সময়, সে প্রতিকূলতা। একাত্তরে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় শিলংয়ে গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ সংগ্রাম সমিতি’। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শিলংয়ের অপেরা হলে একটি বড় জনসভা অনুষ্ঠিত হয় যা থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। আহমদ হোসেন, আফজাল হোসেন ও তাদের বোন আশরাফি বেগম একাত্তরে কাজ করে গেছেন শরণার্থী সহায়তায়। এই পরিবার ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধার কবর দেন পারিবারিক কবরস্থানে। একাত্তরে মেঘালয়ে লুসাই হিলের কমিশনারের স্ত্রী মিসেস সত্যিলন দাসের অবদান ছিল মনে রাখার মতো।

আমপাতি মেঘালয়ের একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালে এটি হয়ে উঠেছিল মিনি বাংলাদেশ। পাকিস্তাানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনার বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। কয়েক মাসের মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫ হাজার। এই অঞ্চলের ভূস্বামী বিজয় সাংমার স্ত্রী রওশন আরা বেগম সাংমা তাদের শুধু থাকার জায়গা দেননি, খাবারের ব্যবস্থাও করেন। প্রতিদিন ভোরে ছয় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি শরণার্থীদের শিবিরে যেতেন। তাঁর সঙ্গে থাকতো বিশাল বিশাল পাতিল-ডেকচিতে ভরা রান্না করা খাবার। তাঁর বাড়ির লোকজন শরণার্থীদের মধ্যে সেই খাবার পরিবেশন করতেন। সবকিছু মিলিয়ে মেঘালয় একাত্তরে পরিণত হয়েছিল বিপুল শরণার্থীর শেষ আশ্রয়স্থলে। মেঘালয়ের প্রশাসনের পাশাপাশি জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের।

ড. শহীদ কাদের চৌধুরী : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App