×

মুক্তচিন্তা

বিজয় দিবসের ভাবনা: ২০১৮

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:২৬ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে রাজনৈতিক ঘটনা ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালে যে একটি সরকার ছিল, সরকারের নেতৃত্বেই যে যুদ্ধ ও আনুষ্ঠানিক সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে-এই ব্যাপারটিতে ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। ইতিহাসের দাবিতে ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দেয়া দরকার। বাংলাদেশের সামনে আছে বিরাট-বিপুল সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার জন্য দরকার উন্নত চরিত্রের নতুন বৌদ্ধিক জাগরণ-নতুন রেনেসাঁস। সেই সঙ্গে দরকার উন্নত চরিত্রের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল ও নতুন রাজনৈতিক চিন্তা। সবই সম্ভব হবে যদি নতুন সচেতনতা দেখা দেয়- নতুন চিন্তাধারা ও কর্মধারা সূচিত হয়।

প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতি ও অগণিত প্রাণের বিনিময়ে আমরা গর্জন করেছি আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই অর্জনের পেছনে আছে দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত গিয়েছে আমাদের গণজাগরণের ও গণআন্দোলনের কাল। তারপর ইতিহাসের প্রকৃতি বদলে যায়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গণজাগরণ ও গণআন্দোলনের ধারা অবমিত হয়নি এবং আন্দোলনের মৌলিক প্রকৃতিও বদলায়নি। গোটা আন্দোলনের ও গণজাগরণের কালে নানাভাবে ব্যস্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জুলুম-জবরদস্তির অবসান ইত্যাদির কথা। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মণি সিংহ ও আরো অনেকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে গণআন্দোলন।

আন্দোলনে একদিকে ছিল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব এবং অপরদিকে ছিল বিপ্লববাদী ও মার্কসবাদী নেতৃত্ব। গণজাগরণ ও গণআন্দোলনের পটভূমিতে আছে বৌদ্ধিক জাগরণ বা রেনেসাঁস। তাতে আছে রামমোহন, ইয়ং বেঙ্গল দল, আক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের সাধনাও স্পষ্ট। এ বৌদ্ধিক জাগরণ, সাধনা ও সৃষ্টির ধারায় আরো আছেন বেগম রোকেয়া, এন ওয়াজেদ আলি, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি নজরুল ইসলাম। রেনেসাঁসের ও গণআন্দোলনের কালে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে, দেখা দেয় দাঙ্গা, বিভক্ত হয় ভারত। হিন্দু-মুসলমান বিরোধের অপঘাত সত্ত্বেও বৌদ্ধিক জাগরণ ও গণজাগরণের মহান দিকটি অনেক বড়। বিজয় দিবসকে, মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীন বাংলাদেশ এই বিস্তৃত ইতিহাসের পটে দেখা দরকার। এই ইতিহাসের পেছনে আছে আমাদের আরো দেড় হাজার বছরের ইতিহাস। সবটাকেই আামদের চেতনায় ধরতে হবে।

১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বর যখন আমাদের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যুক্ত কমান্ডে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর সামরিক আক্রমণ আরম্ভ হয় তখনই বোঝা যাচ্ছিল হানাদার বাহিনী অবশ্যই পরাজিত হবে-তার দিন শেষ। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আরম্ভ হয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। এ কাজ যারা করেছে চেহারা-ছবিতে তারা বাঙালি।

একেবারে শুরু থেকে সবাই মনে করেছেন এ কাজ জামায়াতে ইসলামীর। মুসলিম লীগ ছিল দেশব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সব অপকর্মের দোসর। তবে বিপুল অধিকাংশ পাকিস্তানবাদীরাই যুদ্ধকালে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। অনেকে যুদ্ধকে, হত্যাযজ্ঞকে, ধ্বংসলীলাকে অন্যায় মনে করেছেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে’- এই খবর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও আকাশবাণী কলিকাতা থেকে ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছিল। এর আগের দুদিনও এই দুই মাধ্যম প্রচার করে আসছিল হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সম্ভাবনার কথা। জয়েন্ট কমান্ডের প্রধান লে. জে. অরোরা হানাদার বাহিনীর প্রধান নিয়াজির উদ্দেশে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আহ্বানে বলা হয়েছিল, আত্মসমর্পণ না করলে যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ কল্যাণকর। বলা হয়েছিল আত্মসমর্পণ শান্তিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা হবে এবং জাতিসংঘ ঘোষিত আত্মসমর্পণের নীতি অনুযায়ী আত্মসমর্পণকারীদের রক্ষা করা হবে। ১৬ ডিসেম্বর বেলা ৩টার দিকে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হয়। আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচারিত হয়নি-এক ঘণ্টার বেশি সময় পরে প্রচারিত হয়েছে। ঢাকা শহরে তখনো ভীতি ছিল, সঙ্গে সঙ্গে লোকজন রাস্তায় বের হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে রাস্তায় লোকজন চলা আরম্ভ করে ১৭ ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে। সবাই তখন উদ্বিগ্ন হয়ে শহীদদের খবর নিতে থাকেন, আত্মীয়-পরিজনদের খবর নিতে থাকেন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের খবর শোক ও উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সে সময়ের অনেক স্মৃতি আমাদের মনে জমা হয়ে আছে।

মনে পড়ে ১৬ ডিসেম্বর দিনের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কালে কবি নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র সব্যসাচীর কণ্ঠে সহজ সরল অকৃত্রিম সুন্দর আবৃত্তি-নজরুলের ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি। খবর প্রচার ছাড়া বাকি সবটা সময় সারাদিন এই আবৃত্তি চলেছে।

শহীদ স্মৃতি, শহীদের আত্মীয়-স্বজনের খবর সবার মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল। সে জন্য বিজয়কে উল্লাসের সঙ্গে নেয়নি কেউই। আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত যে এক অনন্য উপলব্ধি।

মুক্তিযোদ্ধারা এখন কয়েকজন একত্রে বাইরে এসেছেন, তখন স্থানীয় ছাত্র-তরুণরা তাদের সঙ্গে মিলে, বন্দুক হাতে, মিছিল করে বাংলাদেশের পক্ষে, বাঙালিত্বের পক্ষে নানা স্লোগান দেন। এর মধ্যে কিছু তরুণ হয়তো নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। শোনা গেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট নিয়েছেন।

রাস্তায় বন্দুক হাতে যে রাজাকাররা চৌকিদারের দায়িত্ব নিয়ে পাহারাদার হিসেবে ঘোরাফেরা করত-বেশির ভাগই অত্যন্ত গরিব- তাদের অনেকের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি এবং আমরা বলাবলি করেছি, রাজাকারদের তো মারা হচ্ছে, কিন্তু যারা রাজাকার তৈরি করেছে, পরিচালিত করেছে, তাদের তো শাস্তি হওয়া দরকার। তাদের শাস্তি কি হবে?

আমরা দেখেছি যুদ্ধের সময়ে এবং যুদ্ধের পরও দু-এক মাস বাঙালি ভ্রাতৃত্বের চেতনা নিয়ে সবাই সততার সঙ্গে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু তারপর সেই সততা, শৃঙ্খলা রক্ষার মানসিকতা আর রইল না। সেদিন সাধারণ মানুষ অত্যন্ত পবিত্র মন নিয়ে আশা করেছিল শুভ যাত্রা। তা হয়নি। ছয় দফা আন্দোলনকালে যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার ছিল, তা নেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, সেই সঙ্গে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব, বামপন্থিদের বিভিন্ন গ্রুপ সক্রিয় ছিল, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলেও নেতৃত্বের ঐক্য ছিল না। আওয়ামী লীগ একলা চলার নীতি নিয়ে চলেছিল। আওয়ামী লীগের ভেতরের শৃঙ্খলা ও সংহতি গড়ে তোলা হয়নি। এই ধারায় চলতে চলতে ঘটে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা। সরকারি দল, সরকারের বিরুদ্ধে কর্মরত বিভিন্ন দল, কোনটার ভূমিকা কী ছিল? ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে, দল গঠনে ও নেতৃত্ব সৃষ্টিতে গুরুত্ব দেয়া করকার।

কিন্তু নেতৃত্বের সেই চেতনা রাজনৈতিক মহলে এবং জনসাধারণের মধ্যে আজো নেই। সিভিল সোসাইটি মহল থেকে পলিটিক্যাল সোসাইটিকে গুরুত্বহীন করার জন্য নাগরিক ঐক্য, নাগরিক উদ্যোগ, সামাজিক আন্দোলন, সামাজিক উদ্যোগ, সুশাসন ইত্যাদির কথা বলা হয়। তাতে রাজনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়-গণতন্ত্রের নামে চলে গণতন্ত্রবিরোধী সব আয়োজন।

নানা দিক দিয়ে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। জনগণ জীবনের তাগিদের উৎপাদন ও সম্পদ বাড়িয়ে চলছে। পর্যায়ক্রমে ন্যায় বাড়ালে এবং অন্যায় কমালে সব মানুষের সম্মানজনক জীবন-জীবিকা সম্ভব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আর চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তির কল্যাণে অনেক কিছু হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জাতি গঠন ও রাষ্ট্র গঠন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব উন্নত হয়নি। সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক উন্নতি।

বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ এমনি নানা কথা মনে পড়ছে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ অস্বীকৃত ছিল। তখন বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। সমাজে তখন স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা ছিল। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, শৃঙ্খলার জন্য সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও সরকার দরকার হয়। আইন-কানুন দরকার হয়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে রাজনৈতিক ঘটনা ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালে যে একটি সরকার ছিল, সরকারের নেতৃত্বেই যে যুদ্ধ ও আনুষ্ঠানিক সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে-এই ব্যাপারটিতে ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। ইতিহাসের দাবিতে ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দেয়া দরকার।

বাংলাদেশের সামনে আছে বিরাট-বিপুল সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার জন্য দরকার উন্নত চরিত্রের নতুন বৌদ্ধিক জাগরণ-নতুন রেনেসাঁস। সেই সঙ্গে দরকার উন্নত চরিত্রের নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল ও নতুন রাজনৈতিক চিন্তা। সবই সম্ভব হবে যদি নতুন সচেতনতা দেখা দেয়-নতুন চিন্তাধারা ও কর্মধারা সূচিত হয়।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App