×

মুক্তচিন্তা

বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০৪ পিএম

১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাক হানাদারদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গণহত্যার শিকার হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবোধের উন্মেষে অবদান রেখেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।

আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার বাহিনীর প্রথম শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীরা এবং আসন্ন বিজয়ের মুহূর্তেও বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। একটি জাতিকে নিস্তব্ধ করে দেয়ার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। নিশ্চিন্ত পরাজয় জেনে হানাদার বাহিনী ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়।

মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনউদ্দিন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)।

১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়া বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় ২০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল।

চৌধুরী মঈনউদ্দিন ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি অবজারভার ভবন থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম-ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহম্মদকে পৌঁছে দিতেন।

এ ছাড়াও আরো ছিলেন এ বি এম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আব্দুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আব্দুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন ইতিহাসের নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

১৯৭১ এ নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ডা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, আনোয়ার পাশা, ডা. জি সি দেব, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডাক্তার ফজলে রাব্বী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দীন আহমেদ, ডা. আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক শহীদুল্লা কায়সার, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, নিজামুদ্দীন আহম্দ, খন্দকার আবু তালেব, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, শহীদ সাবের, বাবু নূতন চন্দ্র সিংহ, রশীদুল হাসান, রণদা প্রাসাদ সাহা, আবুল খায়ের, সিরাজুল হক খান, সেলিনা পারভীন, ড. সাদেক, ড. আমীনুদ্দিন, ড. মুক্তাদির, সাইদুল হাসান, আরো অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা এই দিনে হারিয়েছি।

বধ্যভূমিময় বাংলাদেশের মাটিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অস্থি-মজ্জা-হাড় ৩০ লাখ শহীদের দেহাবশেষের সঙ্গে মিশে আছে। এই দেশের আকাশ তাদেরই শেষ নিঃশ্বাসের বেদনায় নীল। এই বাংলার উদিত সূর্যে তাদেরই রক্তের লালিমা। নদীতে নদীতে তাদেরই অশ্রু বেদনার প্লাবন। এই বাংলাদেশ চিরকাল সেই ঘাতকদের অভিশাপ দেবে। এখনো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জাগ্রত ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর। চিহ্নিত-অচিহ্নিত বধ্যভূমির মাটিতে, ভুলে যাওয়া বন্দিশালার দেয়ালে, স্বজনহারাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো একাত্তরের সব মৃত্যু দুঃখের প্রদীপ হয়ে জ্বলে।

লেখক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App