×

মুক্তচিন্তা

আত্মানুসন্ধান অপরিহার্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০৩ পিএম

যারা বয়সে প্রবীণ, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থানের জন্য গর্ব অনুভব করেন তাদের অনেকেই এখনো মনে করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদেরই মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে রাজনীতি করা সঙ্গত। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও দলের যে দেশে ভোটাধিকার থাকার কথা ছিল না, সেখানে তাদের রাজনীতি করতে দেয়াটা অপরিণামদর্শী, হিমালয় সমান ভুল কাজ হয়েছে। আজ এ ভুল যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া, অতিচেনা মানুষদের নতুন করে করতে দেখি, তখন দুঃখ ও মনোকষ্ট রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ বছর দিনটি আমাদের জন্য নতুন করে বুকভরা বেদনা ও অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে এসেছে। আত্মবিস্মৃতিতে নিমগ্নতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদর্শচ্যুতির প্রসঙ্গ।

তবে দুটি বিষয় এক নয়। প্রথমটি বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে হয়তো বা সংশোধন করা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়টি থেকে আত্মরক্ষা দুঃসাধ্য।

রাজধানীর মিরপুর ও রায়েরবাজারে অবস্থিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সারা বছরই থাকে অরক্ষিত ও অবহেলিত। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয়।

১৯৭২ সালের ২২ ডিসেম্বর এর ফলক উন্মোচন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর প্রধান অংশ দুটি। দক্ষিণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রখ্যাতজনদের জন্য সংরক্ষিত কবরস্থান। উত্তরের বড় অংশটি সাধারণের কবরস্থান।

উত্তর-দক্ষিণের মাঝখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় নির্মাণ করা হয়। দুটি স্মৃতিসৌধেরই এখন বেহাল অবস্থা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি বরাদ্দ নেই। প্রতি বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগে ঘষে মেজে, ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়।

অবিস্মরণীয় ইতিহাস : বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ডিসেম্বর মাস মোটাদাগে কয়েকটি ঘটনার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় ও তাৎপর্যম-িত। দখলদার পাকবাহিনীর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে একাত্তরের এ মাসে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাংলাদেশের আকাশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভারত ও ভুটান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একের পর এক মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বিজয়ের বেশে বিভিন্ন জেলায় প্রবেশ করে। যা চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার দুদিন আগে পাক হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে যে হত্যাযজ্ঞ চালায় তখনো তা অনেকের কাছে ছিল অজানা।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাক হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সহায়তায় একাত্তরের এ সময়টিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের একের পর এক হত্যা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হল, রায়েরবাজার নদীতীর এবং মিরপুরের কয়েকটি স্থানে। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।

দৈনিক পত্রিকাগুলো নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ১৮ ডিসেম্বর একদল সাংবাদিক ঢাকার পশ্চিমে রায়েরবাজার এলাকায় পচনশীল, ক্ষতবিক্ষত লাশের একটি গণকবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যক্তিদের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একে অন্যের নিচে চাপা পড়ে ছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামালউদ্দিন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলিম চৌধুরী, আবুল খায়েরের পচনশীল লাশগুলো পরিবারের সদস্যরা এসে শনাক্ত করেন সে দিনই। সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের লাশ শনাক্ত করা হয় পরের দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ুন কবীর ও মনসুর আলীর লাশ পরবর্তী সময়ে শনাক্ত করা হয়। রায়েরবাজারের যে স্থানটিতে বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত লাশ পড়েছিল সে জায়গাটিকে বধ্যভূমি চিহ্নিত করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রসঙ্গ : স্বাধীনতা মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এ অধিকার অর্জিত হয় অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কূপম-ূকতাকে শিক্ষার ভিত্তিতে জয় করে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ও সব প্রকার শোষণ নিপীড়ন বঞ্চনা থেকে মুক্তির দুর্নিবার আকাক্সক্ষায় অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে। সব দেশে সব সমাজে অগ্রযাত্রার এ পথ পরিক্রমার সব পর্যায়ে নেতৃত্বদান করেন শিক্ষাগুরু, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী ও সমাজের সচেতন বিবেকবান মানুষরা। বাংলাদেশ নামে বিশ্বের ভূখণ্ডে কাঙ্ক্ষিত এ অগ্রগমনেও পথ দেখিয়েছে শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ। তারাই পরাধীন মন মানসিকতার বিপরীতে স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। স্বাধীনতার মানবিক সব আকাক্সক্ষায় দীক্ষা দিয়েছেন।

বিশ্বের অন্যান্য জাতির অনুরূপ বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতায় এ স্বাধীনতা অর্জনে তারা বীর নায়কত্বে বরিত। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের ৩৮ বছর পর্যন্ত, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে শিক্ষা, স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রের পতাকাবাহী, মেধা, মনন ও সাহসিকতায় অনন্য শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, আমাদের জাতীয় বিকাশে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারী শহীদ মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ডা. ফজলে রাব্বী, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদের মতো মানুষদের ইতিহাসের বর্বরতম পন্থায় নৃশংসভাবে হত্যাকারীদের বিচার হয়নি।

তবে অকুতোভয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বাধাকে অগ্রাহ্য করে প্রথমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও পরে উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী, তৎকালীন পাকিস্তানি সামারিক জান্তার প্রত্যক্ষ সহায়তায় হত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধ ও অপকর্মে লিপ্ত, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তির বিচার কাজ সম্পন্ন করেছে।

আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মানুসন্ধান অপরিহার্য : বর্তমান মহাজোট সরকারের সমালোচনার অনেক দিক আছে। কিন্তু তাদের ভালো কাজের তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। অবশ্য দুঃখের ব্যাপার এই সেগুলো জনগণের কাছে যেভাবে তুলে ধরা দরকার, তা করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কীভাবে বিকৃত করা হয়েছিল তা কারো অজানা নয়। তখন বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন বিকৃত ওই ইতিহাস না পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে যে কয়েকটি ভালো কাজ করেছে তার মধ্যে একটি, পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপন এবং একাত্তরে স্বাধীনতার প্রাক্কালে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের কাজ শুরু করা।

যারা বয়সে প্রবীণ, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থানের জন্য গর্ব অনুভব করেন তাদের অনেকেই এখনো মনে করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদেরই মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে রাজনীতি করা সঙ্গত। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ব্যক্তি ও দলের যে দেশে ভোটাধিকার থাকার কথা ছিল না, সেখানে তাদের রাজনীতি করতে দেয়াটা অপরিণামদর্শী, হিমালয় সমান ভুল কাজ হয়েছে।

আজ এ ভুল যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া, অতিচেনা মানুষদের নতুন করে করতে দেখি, তখন দুঃখ ও মনোকষ্ট রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী জামায়াতের সঙ্গে এক কাতারে এক প্রতীকে নির্বাচনকারীদের জন্য ইতিহাসের করুণা অপেক্ষমাণ। রাজনীতিতে জয়-পরাজয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মাকে অস্বীকার ও বিস্মৃতির পাপের মতো জন্মভূমির গৌরব দীপ্ত মর্যাদা হননে অংশগ্রহণও কোনো অংশে কম আত্মঘাতী কার্যক্রম নয়। আত্মবিস্মৃতি ও আদর্শচ্যুতি কোনোটার পরিণামই শুভ হতে পারে না।

তবে আত্মবিস্মৃত মানুষকে সজাগ করার সুযোগ থকলেও আদর্শচ্যুতির চোরাবালিতে পা রাখা মানুষদের তালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল থেকে প্রবলতরই হয়। যেখানে পরিত্রাণের আশা সত্যই অতি ক্ষীণ। এ বছরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মানুসন্ধান সে জন্য অপরিহার্য।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ নেতা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App