×

মুক্তচিন্তা

মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান স্বীকার্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৯ পিএম

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...- এ গানটি শুনে সবাই সঙ্গে সঙ্গেই বলবেন, ‘মান্না দে’র গান? সত্যি তাই, এ বিখ্যাত গানটি গেয়েছেন, অমর শিল্পী মান্না দে। কিন্তু গানটির গীতিকার কে, তা কেউ মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেন না? একটি গান তখনই কালোত্তীর্ণ হয়, যখন এর গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রী একাকার হয়ে যান। কফি হাউসের গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার।

এই কথাটি সেদিন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে বৃহস্পতিবার ৬ ডিসেম্বর ২০১৮, সন্ধ্যায় স্মরণ করিয়ে দিলেন এই কালজয়ী গীতিকারের জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার লেখা গানগুলো মুক্তিযুদ্ধে শক্তি জোগাত। ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের’; ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ-বাংলার মুসলমান-আমরা সবাই বাঙালি-’ অথবা ‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’-?

এগুলো গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা। একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি সম্ভবত প্রবাসী মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার পর প্রচারিত হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষটির অবদান স্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধকালে যে গানগুলো বাঙালিকে প্রেরণা জুগিয়েছে, এর অনেকগুলোর গীতিকার তিনি।

বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে কিছু অসাধারণ বাংলা গান যুগত্তীর্ণ হয়ে গেছে, যার স্বর্ণোজ্জ্বল গীতিকার হচ্ছেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। কে গায়নি তার গান? লতা, কিশোর, মান্না, হেমন্ত, গীতা দত্ত, এসডি বর্মণ, ভুপেন, কে নয়? দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এমন গান লেখা সম্ভব হতো না। গীতিকার, সুরকারকে কেউ মনে রাখে না, পাবনার ছেলেরা যে পাবনার কৃতীদের ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন, তা সত্যি প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশ বা দেশের বাইরে (কলকাতার কথা জানি না), গৌরী প্রসন্ন মজুমদারকে নিয়ে স্মরণসভা বা জন্মদিন কোথাও পালিত হয় বলে শুনিনি। নিউইয়র্কে এবার তাই হয়েছে। ঘোষণা এসেছে, এখন থেকে হবে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের বাড়ি যে পাবনা, তাই আমরা ক’জনা জানতাম? পাবনার ছেলে গোপাল সান্যাল আমাদের তাই জানান দিয়ে গেলেন।

পাবনার সুচিত্রা সেনকেও ইনি আগলে রেখেছেন। লক্ষ্য, এদের স্মৃতিটুকু রক্ষিত হোক, সরকার দায়িত্ব নিক। গৌরী প্রসন্ন মজুমদার বাংলা মায়ের সন্তান। ১৯৬৫ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারত চলে যান। পাবনায় তার সম্পত্তি শত্রু-সম্পত্তি হয়েছে। তার বাড়ির ওপর উঠেছে পঞ্চাশ শয্যার হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে এনেছিলেন।

১৯৭২-এ তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। গিয়েছিলেন পৈতৃক ভিটায়। আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি; রাখার ইচ্ছেও হয়তো ছিল না। আমাদের সম্পদ নিয়ে কলকাতা তাই গর্ব করতে পারছে। তিনি যে শুধু একজন কালজয়ী গীতিকার তা নয়, একজন মানুষ হিসাবে তার আন্তরিকতার একটি প্রাণবন্ত চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছেন কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়।

৪৭ বছর আগেকার ঘটনাগুলো তিনি এমন সাবলীল বর্ণনা করছিলেন যে মনে হচ্ছিল, এই সেদিনের ঘটনা। বোঝা যায়, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার পুত্রসম স্নেহ করতেন রথীন্দ্রনাথ রায়কে। সুখ-দুঃখের স্মৃতি রোমন্থনে হাসি-ঠাট্টা বা কখনো বিষণ্ন বদনে রথীন্দ্রনাথ রায় দীর্ঘক্ষণ সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন। শ্রোতারা একজন দরাজদিল গৌরী প্রসন্ন মজুমদারকে কিছুটা হলেও জানতে পারেন। এরপর আর এক স্বাধীন বাংলা বেতার শিল্পী শহীদ হাসান গানের মধ্যে দিয়ে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হন।

শোন একটি মজিবরের-; কফি হাউস থেকে প্রেমের জগতে তিনি দর্শকের নিয়ে যান। এ সময় অনেকে বলেন, এই গানগুলো যে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের তা তো আমরা জানতামই না। এটাই বাস্তবতা। আমরা গৌরী প্রসন্ন মজুমদারকে জানি না। এই জানার ব্যবস্থাটা করেছিলেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার স্মৃতি সংসদ। সভাপতি,সাংবাদিক, পাবনার আর এক সন্তান ফজলুর রহমান জানালেন, তারা সামনে আরো জানান দেবেন।

প্রেম একবার এসেছিল নীরবে-এ গানটিও গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের। অথবা ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার কানে কানে শুধু একবার বলো’ অথবা ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে শুধু ডাকে-; এই পথ যদি না শেষ হয়; আমার স্বপ্ন তুমি-; আশা ছিল ভালোবাসা ছিল.; পৃথিবী বদলে গেছে.; যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে-; আমি যামিনী তুমি শশী হে-; এসব বিখ্যাত গানেরও রচয়িতা গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। এমন গান লেখা হয়তো তার দ্বারাই সম্ভব!’

১৯২৪ সালে পাবনার এই কৃতী সন্তানের জন্ম ৫ ডিসেম্বর। মৃত্যু ১৯৮৬। মাত্র ৬২ বছরে সঙ্গীত জগতে তিনি দিয়েছেন অনেক। পুরস্কার পেয়েছেন বেশ ক’টি। সাদাকালো সিনেমার জগতে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার একটি স্মরণীয় নাম। নিউইয়র্কের ছোট্ট অনুষ্ঠানটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকল।

কলাম লেখক, নিউইয়র্ক থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App