×

মুক্তচিন্তা

বৈদেশিক বাণিজ্যে অনিয়ম জালিয়াতি প্রতিরোধে মনোযোগী হতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৯ পিএম

বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা দরকার। তাদের কাজ হবে বৈদেশিক বাণিজ্যে বিদ্যমান জালিয়াতির ফাঁক-ফোকরগুলো খুঁজে বের করে তা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশ করা। তবে সবার আগে প্রয়োজন, ব্যাংক ব্যবস্থায় এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহে সুশাসন নিশ্চিত করা। বৈদেশিক বাণিজ্যে সমৃদ্ধি আনতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমদানি-রপ্তানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ এর মাধ্যমে গোটা অর্থনীতিতে সচলতা বজায় থাকে। রপ্তানি বলতে একটি দেশ থেকে অন্য দেশের পণ্য প্রেরণকে বোঝায়। দেশীয় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয়।

সেই অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আবার বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য, যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়। বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যতটা না আমদানি বাণিজ্য। রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে তা দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়।

এ দেশের আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ কম। তাই রপ্তানি বৃদ্ধি বা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ভালো প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য শুভ সংবাদ। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেশের আমদানি সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি হলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকে। নিজস্ব মুদ্রা অর্থাৎ টাকার মান বাড়ে। তখন আমদানি পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকে বা কমে যায়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে জনজীবনে স্বস্তি নেমে আসে।

ইদানীং বৈদেশিক বাণিজ্য ঘিরে জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গোটা অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি দানা বেঁধে উঠছে ক্রমেই। অর্থপাচার, শুল্ক ফাঁকিসহ নানা অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে বিল অব লেডিং এয়ারওয়ে বিল, ট্রাক রিসিপ্টের মতো জরুরি নথি বা দলিল জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাংকে জমা দেয়া পরিবহন সংক্রান্ত নথির ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই মূল কপি ও অনুলিপির মধ্যে অমিল পাওয়া গেছে। কার্গো ক্যারিয়ার বা পণ্য পরিবহন সংস্থার পরিচিতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে। ৮০ শতাংশ বিল অব লেডিংয়ের যথার্থতা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয় ব্যাংকারদের। দিনে দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটার পাশাপাশি নানা ধরনের জালিয়াতির ঘটনাও বেড়ে উঠেছে।

এসব অনিয়ম, জালিয়াতি, দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও জালিয়াতির ধরনে পরিবর্তন আসায় এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় ব্যাংকাররাও ধরতে পারছেন না এসব জালিয়াতি। কারণ ব্যাংকাররা জালিয়াতির ধরন সম্পর্কে কোনো ধারণা লাভ করতে পারছেন না আগে থেকে। ফলে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। এর ফলে রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণ থেকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ বেড়েছে, এটা মানতেই হবে সবাইকে। এসব কারণে ব্যাংকারদের আরো সতর্কতা অবলম্বন একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিল অব লেডিং, এয়ারওয়ে বিল, ট্রাক রিসিপ্টের ক্ষেত্রে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে ব্যাংকারদের।

বৈদেশিক বাণিজ্যে জাল জালিয়াতির প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক, শুল্ক বিভাগ, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, শিপিং লাইন, বাণিজ্যে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রেডিট রিপোর্টের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভা-ার (সেন্ট্রাল ডাটাবেজ) তৈরি করতে সক্ষম হলে ঝুঁকি ও খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সেন্ট্রাল ডাটাবেজ থাকলে কোনো ভুয়া ক্রেডিট রিপোর্ট সরবরাহের সুযোগ থাকবে না।

এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসবে, কমবে অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনাও। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে দিনে দিনে বৈদেশিক বাণিজ্যে জালিয়াতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের ৮৩ শতাংশ ঘটছে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে।

এ ক্ষেত্রে ব্যাংক যদি সতর্ক ও সাবধানী হয় তাহলে অনিয়ম ঘটার সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার কতটা বেড়েছে তা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। আমাদের রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির পেছনেও অর্থ পাচার অনেকটা দায়ী। অর্থ পাচারের সম্ভাব্য পথগুলো খুঁজে বের করা এবং তা কঠোরভাবে বন্ধে সরকারের আরো বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা। কিন্ত এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত উদ্যোগগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী সুফল বয়ে আনতে পারেনি। এর পেছনে অবশ্য নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের অভাবই দায়ী।

ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের যাবতীয় নথি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত। বেশিরভাগ ব্যাংক গ্রাহক প্রদত্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী মিথ্যা বা ভুয়া তথ্যের আশ্রয় নিয়ে অর্থ পাচার ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চলেছেন। এ ধরনের প্রবণতা অবিলম্বে রোধ করতে ব্যাংকগুলোকে আরো অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বও কোনো অংশে কম নয়। তাদের উচিত কেস টু কেস বা পর্যায়ক্রমিকভাবে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্যের নথি পর্যালোচনার প্রতিবেদন খতিয়ে দেখা, কোথাও গরমিল খুঁজে পাওয়া গেলে অধিক যাচাইয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক বা কোনো ব্যাংকের এককভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের নথি ঘিরে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়।

এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত জরুরি। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ও এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর এ ক্ষেত্রে অনেক অসাধু ব্যবসায়ীও সুযোগ নিয়ে থাকেন। বর্তমানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ব্যবসায়িক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও সঠিকতা নিশ্চিত করেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যকে আরো স্বচ্ছ ও মসৃণ করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং এ ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি জোরদার করা জরুরি। পৃথিবী যেসব দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে সাফল্য অর্জন করেছে তাদের অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যকে গতিশীল ও স্বচ্ছ করে তোলার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আর এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা দরকার। তাদের কাজ হবে বৈদেশিক বাণিজ্যে বিদ্যমান জালিয়াতির ফাঁক-ফোকরগুলো খুঁজে বের করে তা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে সুপারিশ করা।

তবে সবার আগে প্রয়োজন, ব্যাংক ব্যবস্থায় এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহে সুশাসন নিশ্চিত করা। বৈদেশিক বাণিজ্যে সমৃদ্ধি আনতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করবে।

রেজাউল করিম খোকন : লেখক ও ব্যাংকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App