×

জাতীয়

জাপার উন্মুক্ত ১৪৫ নিয়ে উৎকণ্ঠায় নৌকার প্রার্থীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:০৬ পিএম

জাপার উন্মুক্ত ১৪৫ নিয়ে উৎকণ্ঠায় নৌকার প্রার্থীরা
নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনে মহাজোট থেকে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আফতাব উদ্দিন সরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে ১৫ হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী জাফর ইকবাল সিদ্দিকী। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় মহাজোটের হয়েই জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আফতাব উদ্দিন সরকারই হবেন জোটের প্রার্থী। জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী থাকবে না। ফলে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের অন্যান্য শরিকরা নৌকার পক্ষেই কাজ করবেনÑ এমন ধারণা ভোটারদের। কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ঘোষণা আসে মহাজোটের ২৯টি ছাড়াও জাতীয় পার্টির ১৩২ আসনে দলটির প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে থাকছেন। এর মধ্যে রয়েছে নীলফামারী-১ আসনও। এই ঘোষণা আসার পর থেকেই অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, ধানের শীষের সঙ্গে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে না থাকলে ভোটারদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। এই সুযোগটি নেবে প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীরা। তবে নৌকার প্রার্থী আফতাব উদ্দিন সরকারসহ দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, নৌকাকে আমরা বিজয়ী করতে পারব। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী না থাকলে প্রচারণায় আমরা সহজে এগিয়ে থাকতাম। পরিশ্রম কম হতো। কিন্তু জাপা নির্বাচনী মাঠে থাকায় নৌকার বিজয়ে আমাদের বেশি পরিশ্রম করতে হবে। ভোটারদের বিভ্রান্তি দূর করতেও মাঠে জোরালোভাবে নামতে হবে। শেষ পর্যন্তও নৌকা বিজয়ী হবে এমনটিই মনে করেন তারা। এই আসনের প্রবীণ ভোটার মাহবুবার রহমান। তিনি বলেন, ’৭০-এর নির্বাচন ও স্বাধীনতার পর সব নির্বাচনে নৌকা সবসময় বিজয়ী হয়েছে। ১৯৯৬ সালে অল্প ভোটের ব্যবধান ও ২০০৮ সালে মহাজোট থেকে দলটি বিজয়ী হয়। এ ছাড়া প্রতিবারই নৌকা জয়ী হয়। এখানে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে। বিএনপির ভোট বেশি নেই। তবে বড় ব্যবধানে বিজয়ী হতে এখানে লাঙ্গলের প্রার্থী না থাকলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে। তার প্রত্যাশা, নির্বাচনের আগে হলেও জাতীয় পার্টি তাদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করবে। শুধু নীলফামারী-১ আসনেই নয়। লাঙ্গলের প্রার্থী থাকায় অনেকটা উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের দেড় শতাধিক প্রার্থী। বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুরের আসনগুলোতে। কারণ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে রংপুরের আসনগুলো জাপার ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত। যার প্রমাণ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ বিগত সময়ের সংসদ নির্বাচনগুলো। দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনে মহাজোটের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মনোরঞ্জর শীল গোপাল। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে সম্প্রতি দুই উপজেলায় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তাকে মনোনয়ন না দেয়ারও দাবি জানানো হয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে। এ নিয়ে বেশ উত্তাপও ছড়ায়। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে শোকজ করে দলটির হাইকমান্ড। ফলে বর্তমান সংসদ সদস্যদের প্রতি ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। তারপরও গোপালকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিক্ষুব্ধ নেতারা নৌকার পক্ষে কাজ করে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ আসনে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন জাপার প্রার্থী শাহীনুর আলম। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের বড় অংশটি মহাজোটের শরিক ভেবে লাঙ্গলের পক্ষে কাজ করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেক্ষেত্রে নৌকা-লাঙ্গলের এই লড়াইয়ের সুফল চলে যেতে পারে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী জামায়াত নেতা আবু হানিফের ঘরে। তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করছেন। গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে ২০০১ সালে বিএনপির মোত্তালিব আকন্দ ৯৬ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। সেখানে আওয়ামী লীগের মোজাম্মেল হোসেন প্রধান পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ভোট। আর জাতীয় পার্টির লুৎফর রহমান চৌধুরী পেয়েছিলেন ৬৭ হাজার ভোট। এই রকম অনেকগুলো আসন রয়েছে, যেখানে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ভোট একসঙ্গে যোগ হলে বিএনপিকে হারানো সম্ভব। এদিকে মহাজোট থেকে ২৯টি পেলেও ১৩২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকার ঘোষণায় নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। এর বাইরে ইসিতে আপিল করে আরো ১৩ থেকে ১৫টি আসনে দলটির প্রার্থিতা থাকতে পারে বলে জানান জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাহলে জোটের বাইরে ১৪৫টি আসনে জাপার প্রার্থী থাকছে মাঠে। যার প্রতিটিতেই নৌকার প্রার্থী রয়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া ২৯টি আসনে আওয়ামী লীগ থেকে কোনো প্রার্থী দেয়া হয়নি। এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাগাভাগিতে ২৯টি আসন পাওয়ায় জাতীয় পার্টি সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব। তারপরও বৃহৎ স্বার্থে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতেই বিষয়টি মেনে নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। গতকাল তিনি বলেন, ঠিক মূল্যায়ন বলতে যা বুঝায়, তা নয়, কর্মীরা সন্তুষ্ট নয়, আমরাও সন্তুষ্ট নই। ব্যক্তিগত ভাবেও আমি সন্তুষ্ট নই। এক পরিবারে থাকলে গণ্ডগোল হতে পারে। তারপরও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই মিলেমিশে থাকতে হয়। সোমবার রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৬ আসনে মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ জানান, এটি আমাদের একটি কৌশল। রাজনীতিতে সবসময় বড় খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় পার্টিই খেলে থাকে। প্রতিটি খেলায় আমাদের জেতারও রেকর্ড আছে। কোনো খেলায় হারিনি। এ খেলাতেও আমরা ও মহাজোট হারব না। তিনি আরো জানান, আমাদের কাছে তথ্য আছে; জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মহাজোটের সঙ্গে আলোচনা করেই জাতীয় পার্টি দেড়শর মতো আসনে প্রার্থী রেখেছে। ফাঁকা মাঠে খেলা হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী মাঠে থাকে, তাহলে যাদের আমরা অতিরিক্ত হিসেবে মাঠে রেখেছি, দলের সিদ্ধান্ত মেনে, তারা সবাই নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না বলেও জানান তিনি। তাছাড়া মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীদের বিদ্রোহ দমনেরও একটা কৌশল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে অন্যবারের তুলনায় প্রার্থী ঘোষণায় শুরু থেকেই এবার কৌশলী অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। কয়েকদফা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণার কথা থাকলেও তা করেনি দলটি। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে বারবারই বলে আসছিলেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে কৌশলের খেলায় পিছিয়ে থাকতে চাই না। এজন্যই মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময়ই জানা যাবে, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থী কারা। এদিকে মহাজোটের অন্য শরিক বিকল্পধারা ৩টি আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলেও ২০টি আসনে থাকছে তাদের প্রার্থী। যাদের সবাই বিকল্পধারার প্রতীক কুলা মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন; বিকল্পধারার প্রেসিডিয়াম সদস্য বিএনপির সাবেক নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি সিলেট-৬ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছাড়াও ১০ বছর ধরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এ ছাড়া দলটির অন্য দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম সারোয়ার মিলন মানিকগঞ্জ-২ ও এস এম গোলাম রেজা সাতক্ষীরা-৪ আসনে নির্বাচন করবেন। এ দুটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেগম মমতাজ ও জগলুল হায়দার। এ ছাড়া আরো ১৭টি আসনে নির্বাচন করবেন তারা। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি নীলফামারী-১ আসনে গাভি প্রতীকে নির্বাচন করছেন। মহাজোটের ৩টি ছাড়াও দলীয় প্রতীক মশাল মার্কায় জাসদের (ইনু) চারজন প্রার্থী নির্বাচনে থাকছেন বলে জানা গেছে। ৯৫টি আসনে নির্বাচনী মাঠে থাকছে জাকের পার্টিও। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জোটের সিদ্ধান্তে জাপাকে যেসব আসন দেয়া হয়েছে, সেগুলোতে তারাও খুশি, আমরাও খুশি। এর বাইরে যেসব আসনে জাপা প্রার্থী দিয়েছে, সেটি তাদের একান্ত সিদ্ধান্ত, জোটের নয়। তবে জাপার প্রার্থী থাকায় ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করে এই আওয়ামী লীগ নেতা। তার মতে, জাতীয় পার্টির ভোট কখনোই আওয়ামী লীগ পায় না। তাদের ভোটগুলো আমাদের প্রতিপক্ষের প্রতীকেই যায়। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই লাভবান হবে। তিনি আরো বলেন, এটি জাতীয় পার্টির কৌশল হতে পারে, আমাদের নয়। তাদের কৌশল অনুযায়ী নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের সামলানোর দায়িত্ব তাদেরই। সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বলেন, এটি জাপার একান্ত সিদ্ধান্ত। তাদের এই সিদ্ধান্ত ভোটের বাজারে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না তা এখনই বলার সময় আসেনি। সময় হলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App