×

মুক্তচিন্তা

প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০৮ পিএম

যে সমাজ সংসারে আমরা সময় অতিক্রম করছি সেখানে একদল অসুস্থ মানুষ সব কিছু নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। যে গ্রামে আমাদের বেড়ে ওঠা সেখানে মানবিকতা ছিল। শিক্ষক ছিলেন আদর্শবাদী। শিক্ষকতা ব্যবসা, বাণিজ্যে পরিণত হয়নি। জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শহরে এসে বিপাকে পড়ে গেলাম।

নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। শিশু-কিশোর সন্তান তার ওজনের থেকে কয়েকগুণ ভারী ব্যাগ নিয়ে কোচিংয়ে গিয়ে মুখস্থ বিদ্যা নিয়ে বিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে লাগালো। ভর্তির পর দল বেঁধে কোচিং সেন্টারে যাতায়াত তার শুধু বাড়লো তা নয়, বরং অভিভাবকদের দৌড়ছুট আর অর্থলগ্নি বেড়ে স্ফীত হলো।

ভিকারুননিসা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী অন্যদিনের মতো পরীক্ষা দিতে স্কুলে গিয়েছিল। শিক্ষক পরীক্ষা হলে তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন জব্দ করে। মোবাইল ফোনে প্রশ্নের উত্তরের আলোকচিত্র ধারণ করা নাকি ছিল। তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়।

পরের দিন অরিত্রীর বাবা-মা স্কুলে ছুটে যান। অধ্যক্ষসহ অন্য শিক্ষকরা অরিত্রীর সামনে তার বাবা-মাকে অপমান করে টিসি নিয়ে অন্যত্র ভর্তি হতে বলে। অরিত্রী তার বাবা-মার অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেয়। হাজার হাজার ছাত্রীদের মধ্যে তার মেধা তালিকায় স্থান ছিল দ্বাদশতম। বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে অরিত্রী উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রার স্বপ্ন বুনতো। আশায় গুড়েবালি। কী এক অদৃশ্য বালিয়াড়ীতে হারিয়ে গেল অরিত্রী। যে শিক্ষক শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব বোঝে না সে কীভাবে শিক্ষকতার মহান পেশায় আসীন থাকে। শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করার বিষয়টি উচ্চতর আদালত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার কথা বলেছে।

একসঙ্গে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। পত্রিকার সংবাদ সূত্র থেকে পাওয়া গেছে ভয়াবহ খবর। একজন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে নাকি ‘দশ লাখ’ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একজন ছাত্রীকে তাড়িয়ে দিতে পারলে নাকি আরো দশ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। এ বাণিজ্য নাকি ছাত্রী বিতাড়ন নাটকের পেছনে রয়েছে। নামি স্কুলগুলেতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে।

অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে অর্থলগ্নি করেন। নামি স্কুল থেকে ভালো করে মফস্বল থেকে আসা ছেলেমেয়েরা। অরিত্রীর শ্রেণি শিক্ষককে গ্রেপ্তার আর একদিকে সাধারণ ছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছে।

অন্যদিকে শ্রেণি শিক্ষিকার পক্ষাবলম্বনকারী শিক্ষক-ছাত্রীদের অংশ শ্রেণি শিক্ষককে মুক্তির সংগ্রামে একাট্টা হয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। অরিত্রীর বাবা-মা মেয়ের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তাদের ভাগ্যে লাঞ্ছনা জুটেছে। তদন্ত কমিটি মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি। যাচাই-বাছাই না করে শিক্ষক কেন এক হাত নিলেন, এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। বিনা দোষে এ সমাজে শাস্তি হয় বিস্তর।

মধ্যবিত্ত পরিবার যে স্বপ্ন দেখেছিল তা ভেস্তে গেছে। ক্ষমা, মানবিকতার দিক এ সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। রূঢ় ব্যবহার আর শাস্তির দশদিক খুলে দিয়ে অসুস্থ একদল মানুষ সমাজকে রোগাগ্রস্ত করে তুলছে দিন-রাত। শিক্ষক-ব্যবসায়ী এক আতঙ্কের নাম। তার কাছে সবার সহজ প্রবেশ সম্ভব নয়। কী এক নিষ্ঠুর বেড়ি চারপাশে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো যায় কিন্তু শিক্ষকের কাছে পৌঁছানো যায় না এমন মন্তব্য ভুক্তভোগী অভিভাবকদের।

পাশ্চাত্যে নাকি পরীক্ষা হলে বই খুলে উত্তর লিখতে দেয়া হয়। পড়া না থাকলে বই দেখে উত্তর লেখা যায় না। আর একটি বিষয় স্কুলেই শেষ হয় পড়ালেখা। বাড়িতে চাপ থাকে না। পাশ্চাত্যের অনেক কিছুই আমরা অনুসরণ করি। ভালো কিছু নয়।

মুনাফালোভী বণিক শিক্ষক স্কুলে কিছু শেখায় না। বাড়িতে, কোচিং সেন্টারে ডাকে। মূর্খ অভিভাবক টাকার বান্ডিল হাতে ‘শিক্ষা’ কেনার জন্য ছোটে। চারদিকে এক ধস নেমে গেছে। এ ধস থেকে বেরিয়ে না এলে বিপর্যয় অনিবার্য। মহল্লায় মহল্লায় ভালো স্কুল গড়ে তুলতে হবে। নামিদামি স্কুল ত্যাগ করা জরুরি। আমাদের দেখা সেই গ্রামের স্কুলের আদলে স্কুল গড়ে তুলতে হবে।

এটা ঠিক যন্ত্র অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। আবেগ, ভালোবাসা এসব তলানিতে এসে পৌঁছলেও সব মানুষ অমানুষদের ভিড়ে হারিয়ে গেছে এ বিশ্বাস আজো করি না। মানবিক জাগরণ প্রয়োজন। অর্থ ও প্রতিষ্ঠার অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে সমাজ, সংসারকে বাঁচাতে হবে। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। কোন অবহেলায়, অযত্নে এদের হারিয়ে ফেলার ভয় যেন আমাদের তাড়া করে আনা না ফেরে।

কবি ও লেখক, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App