×

মুক্তচিন্তা

ডিজিটাল সিস্টেম ও ডিজিটাল অপরাধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৪২ পিএম

ব্যক্তিগতভাবে এসব জটিল কাজ করা প্রায় দুরূহ। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো না কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদি কেউ ধারণা করে থাকেন যে, শুধু গার্হস্থ্য কলেজের মেয়েটিই সাইবার ক্রাইমের শিকার, তবে ভুল করবেন। কারণ এই মেয়েটি সম্ভবত লাখো মেয়ের একজন প্রতিনিধি। এ মামলার মাধ্যমে সম্ভবত কোটি সাইবার অপরাধের কেবল একটি অপরাধ ঢাকার আদালতে ঠাঁই পেয়েছে। এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে। নতুন আইন হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮।

ডিজিটাল প্রযুক্তির মূল কেন্দ্র ডিজিটাল সিস্টেম বিধায় এই সিস্টেমকে ব্যবহার করে যে ব্যাপক অপরাধ করা হবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। ডিজিটাল সিস্টেম বিষয়ক অপরাধের সীমানাটাও অনেক বড়। ডিজিটাল যন্ত্রের বিদ্যমান তথ্য নষ্ট করা, ডিজিটাল ডাটা মুছে ফেলা, এতে ভাইরাস-ম্যালওয়্যার-স্প্যামওয়্যার ছড়ানো, তথ্য-উপাত্ত চুরি করা, নেটওয়ার্ক অকার্যকর করা, ডিজিটাল সিস্টেম অকার্যকর করা, অ্যাপস বা সফটওয়্যারের সোর্স কোড চুরি করা ইত্যাদি নানা ধরনের ডিজিটাল অপরাধ হয়ে থাকে। আমার কাছে এমন কিছু দৃষ্টান্ত আছে যাকে সিস্টেম বিষয়ক অপরাধ ছাড়াও পাইরেসিও বলা যাবে। আবার সিস্টেম চুরিও বলা যাবে।

সিস্টেম বিষয়ক অপরাধের একটি বিবরণ এর মাঝে আমার কাছে উপস্থিত হয়েছে। একে ডিজিটাল সিস্টেম বিষয়ক অপরাধের পাশাপাশি পাইরেসিও বলা যাবে। এক ভদ্রলোক বাংলাদেশের আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন। একটি বড় মাপের কম্পিউটার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তার কিছু অসততার জন্য তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর তিনি একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানেও তিনি সোর্স কোড চুরি করার দায়ে চাকরি হারান। এরপর তিনি সফটওয়্যার কোম্পানির অন্যতম পরিচালক একজন মহিলাকে নিয়ে একটি গানের ভিডিও করেন। এরপর সেটি তিনি ইন্টারনেটে প্রচার করেন। মহিলা সম্পর্কে যত বাজে কথা বলা সম্ভব তার সবই তিনি ভিডিওতে বলেছেন।

সেই মহিলা এক সময়ে আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬-এর আশ্রয় নেন। র‌্যাব তাকে আটক করে। তিনি দুই মাসেরও বেশি জেলে ছিলেন। এরপর জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারো ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে মহিলার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে শুরু করেন। মহিলা রূপসী, যুবতি, গৃহিণী এবং সন্তানের জননী। তাকে নিয়ে সেই ভদ্রলোক পরকীয়ার কাহিনী রচনা করেছেন এবং যত জায়গাতে সম্ভব তিনি সেই কাহিনী প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। সেই মহিলা এরপর ভাবলেন, আইসিটি অ্যাক্ট নয়, তাকে শিশু ও মহিলা নির্যাতন আইনে মামলা করতে হবে। কারণ আইসিটি অ্যাক্ট তাকে রক্ষা করতে পারছে না।

শুধু তাই নয়, পুলিশ বহুদিনেও আইসিটি অ্যাক্টের অধীনে আসামির বিরুদ্ধে কোনো চার্জ ফ্রেম করতে পারেনি। ইন্টারনেটে ভিডিওটি বহুদিন বহাল তবিয়তে ছিল- কিন্তু পুলিশের এসআই সাহেব সেখান থেকে কোনো মামলা তৈরি করতে পারছেন না।

ক’দিন আগে ঢাকা থেকে আরেক ভদ্রলোক আমাকে ফোন করেন। তার কণ্ঠে উদ্বেগ। তিনি জানালেন যে, তার মেইল একাউন্ট থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেইল গায়েব হয়ে গেছে। তার একজন শত্রু আছে। তার ধারণা সেই শত্রু তার মেইলগুলো কোনো না কোনোভাবে চুরি করে নিয়ে গেছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে থানার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা বলেছে, আপনার মেইল চুরির জন্য কোন ধারায় মামলা হবে সেটি আমরা জানি না।

শুধু এখনই নয়, এমন অপরাধ বহু বছর আগে থেকেই ঘটে চলেছে। আমি নিজে ১৯৯৩ সালে এমন অপরাধের শিকার হই। সেই সময়ে আমার সঙ্গে কাজ করত এমন একজন প্রোগ্রামার আমার সফটওয়্যারের সোর্স কোড চুরি করে নিয়ে যায়। এমনকি আমার একটি কম্পিউটারও নিয়ে যায়। আমি যখন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি পুলিশ তখন আমাকে কম্পিউটার চুরির জন্য মামলা করতে বলে। কিন্তু সোর্স কোড কী এবং কেমন করে সেসব চুরি হয় সেটি পুলিশকে বোঝাতে পারিনি।

অথচ আমার জন্য কম্পিউটারের ক্ষতি ছিল ষাট হাজার টাকা আর সোর্স কোডের দাম ছিল ষাট লাখ টাকা। সেই প্রোগ্রামার আমার সোর্স কোড দিয়ে অন্তত ছয় কোটি টাকা উপার্জন করেছে।

আমার ধারণা ছিল আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬-যেটি ২০০৯ সালে সংশোধিত হয়েছে সেটির বদৌলতে আমরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাব। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আমি বহু চেষ্টা করেও মামলাই করতে পারিনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত টাইম পত্রিকার উপসংহার এ রকম :

There is no denying that physical safety is and always will be our priority. But we ignore the safety of our digital world at our own peril, precisely because the dichotomy between the physical and digital worlds is a false one. There is no such thing as stand-alone cyberspace it's just another dimension of our lived existence. Part of our struggle to address these digital threats is because we lack any visceral, physical connection to them the way we have with images of war and suffering. Yet it would be a mistake to minimize these types of threats simply because we can't see them or because the attackers are often invisible. The consequences are all too real. And, with a simple shift in outlook, we can start to lock the barn door before the horse is gone. (http://time.com/4263185/digital-warfare/)

মামলা: ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে এরই মাঝে দেশে একাধিক মামলা হয়েছে। সরকার প্রথম মামলাটি করে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে সেই মামলাটি করা হয়। ওই মামলায় মাহমুদুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে দেশে মামলা হয়েছে আরো অনেক আগে। অনেক বড় খবরের মাঝে ছোট একটি খবর ছাপা হয়েছিল নানা পত্রিকায়।

খবরটি হচ্ছে; ঢাকার গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজের একজন ছাত্রী বাংলাদেশের প্রথম সাইবার ক্রাইমের মামলাটি করেছেন। আইসিটি আইনের ৫৬ ও ৫৭ ধারায় তিনি এ মামলাটি করেন। ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে এ মামলাটি দায়ের করা হয়।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সূত্রে সঞ্জয় নামক এক যুবকের সঙ্গে ওই ছাত্রীর পরিচয় হয়। পরে আবু রেজা নামক আরেক যুবকের সঙ্গে সেই ছাত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তারা তাকে ভালো চাকরি দেয়ার নাম করে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকা অফিসে নিয়ে যায়। তারা জানায়, আলোছায়া নামে কালের কণ্ঠের একটি প্রকাশনা আছে। আবু রেজা সেই পত্রিকার প্রকাশক ও সঞ্জয় দে তার সম্পাদক বলে দাবি করেন।

ছাত্রীটি অভিযোগ করে যে, ২০১০ সালের ১ জুন তাকে আলোছায়া পত্রিকায় চাকরি প্রদান করা হয়। এরপর সঞ্জয় তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ছাত্রীটি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সঞ্জয় ও আবু রেজা তার ছবি তোলে। সেসব ছবি বিকৃত করে তারা ছাত্রীর নামে একটি ফেসবুক আইডি খোলে। এক সময়ে তার একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে এবং তার বিকৃত ছবি ব্যবহার করে তার বিয়েটা ভেঙে দেয়া হয়। ফেসবুকে রিপনকে তার স্বামী হিসেবে দেখানো হয় এবং মোবাইলে তার পরিবারের কাছে চাঁদাও দাবি করা হয়।

আদালতে মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা হলেও নাড়াচাড়া হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের মামলায় যে মেয়েটি মামলা করেছে তার জন্যই অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমি ঠিক জানি না মেয়েটি কী ধরনের প্রমাণ হাতের কাছে রেখে মামলা করেছে। ইন্টারনেটের ফেসবুকে কৃত অপরাধ মুছে ফেলা কোনো কঠিন কাজ নয়। অন্তত লুকিয়ে রাখা তো যায়। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এত কাছের মানুষ নয় যে ইচ্ছে করলে তাদের কাছ থেকে খুব সহজে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে মেয়েটি যদি বুদ্ধিমতী হয়ে থাকে তবে ডিজিটাল প্রমাণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেখে দেয়া হয়ে থাকতে পারে। যারা মেয়েটির নামে ভুয়া একাউন্ট খুলেছিল বা ফেক প্রোফাইল দিয়েছিল তার প্রমাণ নিশ্চয়ই তারা এখন আর রাখেনি। যেহেতু হিসাবের নিয়ন্ত্রণ তাদের কাছে ছিল সেহেতু তাদের পক্ষে একাউন্ট ডিএকটিভেট করা খুবই সহজ কাজ হবে। আমি আশা করব, মেয়েটি যেন বুদ্ধিমতী হয়ে থাকে। সে যদি তার নিজের মোবাইল ফোন বা পিসির মতো ডিজিটাল যন্ত্রকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে থাকে, যদি কল বা এসএমএস মুছে না ফেলে থাকে বা কথোপকথন যদি রেকর্ড করে থাকে এবং যদি ফেসবুকের তথ্যগুলোকে যথাসময়ে সংরক্ষণ করে থাকে তবে তার পক্ষে অপরাধীদের ঝুলিয়ে দেয়া কঠিন হবে না। এই দুটি ঘটনার পর আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় হয়েছে বলে গণ্য হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে আমি আইএসপি সমিতির মহাসচিব হাকিমের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এ ধরনের কর্মকা-ের খতিয়ান বের করা সম্ভব। ইন্টারনেট থেকে আপাতদৃষ্টে তথ্য মুছে ফেলা হলেও সেই তথ্য কখন কোন আইপি ঠিকানা থেকে প্রদান করে কতক্ষণ রেখে মুছে ফেলা হয় সেসব তথ্য এখন উদ্ধার করা যেতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে এসব জটিল কাজ করা প্রায় দুরূহ। এ জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো না কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

যাহোক, যদি কেউ ধারণা করে থাকেন যে, শুধু গার্হস্থ্য কলেজের মেয়েটিই সাইবার ক্রাইমের শিকার, তবে ভুল করবেন। কারণ এই মেয়েটি সম্ভবত লাখো মেয়ের একজন প্রতিনিধি। এ মামলার মাধ্যমে সম্ভবত কোটি সাইবার অপরাধের কেবল একটি অপরাধ ঢাকার আদালতে ঠাঁই পেয়েছে।

এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে। নতুন আইন হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ১৮। সামনের দিনে নতুন আইন এবং ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App