×

বিনোদন

কিংবদন্তির কথা থাকে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৫:৩১ পিএম

‘দিন যায় কথা থাকে...’। ঠিক যেন এই গানটির মতোই সময় পাল্লা দিয়ে বয়ে চলে আপন গতিতে। বাংলা গানের জগতে দীর্ঘ সময় কোটি কোটি ভক্ত শ্রোতাকে সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে শিল্পী সুবীর নন্দী তার জীবনের আরো একটি নতুন বছরে পা দিলেন। গতকাল ৩০ নভেম্বর ছিল নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দীর ৬৫তম জন্মদিন। নতুন নতুন জনপ্রিয় সব গান উপহার দিয়ে ভক্তদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই শিল্পী আজো গেয়ে চলেছেন আপন মহিমায়। গানের সঙ্গে দীর্ঘ বছর জড়িয়ে রয়েছেন এ গুণী মানুষটি। আর দুর্দান্ত সব গান গেয়ে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনকে করেছেন দারুণভাবে সমৃদ্ধ। বাংলা আধুনিক গানের সঙ্গীত জগতে একজন উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তিনি। যিনি ইতোমধ্যে স্বকীয় সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে নিজের দেশ ও দেশের সীমানা পেরিয়ে শ্রোতাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে নিজস্ব আসন তৈরি করে নিয়েছেন। মূলত তিনি একজন সুর সাধক; ঈশ্বর প্রদত্ত গলার কারুকাজে গত শতকের আশি দশকের শুরু থেকে একের পর এক সব কালজয়ী গান উপহার দিয়ে মুগ্ধ করে চলেছেন হাজারো ভক্তক‚ল মানুষের মনন-হৃদয়। গেয়েছেন অসংখ্য মৌলিক গানসহ বিভিন্ন সিনেমার প্লেব্যাকে। সবমিলিয়ে প্রায় ২৫০০-এর মতো গানের স্রষ্টা তিনি। নিজেও গান লিখেছেন, সুর করেছেন। যদিও তার মতে, ‘গানের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা তেমন কিছু নয়, গানের মতো গান, উপন্যাসের মতো উপন্যাস, মনে রাখার মতো একটা কিংবা দুটা হলেই হয়তো বা যথেষ্ট’। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘ বরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ, দুই চোখে তার-আহারে কী মায়া’। লাইনগুলো যার সম্বন্ধে বলা- এসব তার কথা নয়, আবার তার-ই কথা! সুবীর নন্দী, এমনই একজন গায়ক- যার কথা বলতে গেলে চলে আসে শত শত গানের কথা, যেসব গান তিনি নিজে গেয়েছেন বা সুর করেছেন। এই গানের কথাগুলো হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের একটি গানের অংশ বিশেষ। হুমায়ূন আহমেদ রচিত অসাধারণ লিরিকে মাকসুদ জামিল মিন্টুর কম্পোজিশনে গানটি গেয়েছিলেন সুবীর নন্দী। সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা সবাই জানেন, এ গানটি যার উদ্দেশ্যে সেই সবুজ বরণ মেয়েটি বেড়ে ওঠেন সবুজ-শ্যামল-ছায়া ঘেরা নদীমাতৃক ভাটি বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কথাগুলো যে জন্য বলাÑ তা হলো, আমাদের কিংবদন্তি সুরকার-সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী, তারও শৈশবও কেটেছে এমনই এক ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা অজপাড়া গাঁয়ে। বাবার চাকরি সুবাদে চা-বাগান, টিলার আশপাশে প্রকৃতির এক মনোরম পরিবেশে। তার জন্মস্থান সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দীপাড়া নামক গ্রামে। জন্মেছিলেন সম্ভ্রান্ত সঙ্গীত লালিত পরিবারে। তার মা পুতুল রানী, যিনি নিজেও গান করতেন এবং বাবা সুধাংশু নন্দী ছিলেন খুবই সঙ্গীত অনুরাগী। তবে সুবীর নন্দীর গানের হাতেখড়ি ছিল মায়ের কাছ থেকে। পাশাপাশি অন্যান্য ভাই-বোনদের সঙ্গে তিনিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিমে যেতেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের নিকট। সুবীর নন্দীর ছিল ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি অকৃত্রিম প্রেম। যেন গানই জীবন, গানই মরণ, গানই তার বন্ধু অথবা ভাই! তার গানগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালে, বিশেষ করে গানের লিরিকের দিকে তাকালে বুঝা যায়- গানগুলো ঘিরে রয়েছে মানুষ জীবনের অন্তর্বেদনা, প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। যার ফলে তার গানের এ বিষয় বাস্তবতাগুলোই আন্দোলিত করে শ্রোতাদের আবেগী মন। তাই হয়তো কোনো প্রেমিক, হতে পারে সে ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা অব্যর্থ, অথবা জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় আটকা পড়া একজন বিবাগী যে আনমনে গেয়ে ওঠে- ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। আবার কখনোবা অভিমানী মন গেয়ে ওঠে- ‘যদি কোনোদিন আমার পাখি, আমায় ছেড়ে দূরে চলে যা, একা একা রব নিরালায়’। যদিও পৃথিবীতে প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি। স্বার্থপর পৃথিবীতে একমাত্র ভালোবাসা-ই মানুষকে বাঁচাতে শেখায়, আবার ব্যতিক্রমও হয়- অনেক কে ভালোবাসা নিঃস্বও করে দেয়। ব্যক্তি জীবনের অংশ হিসেবে আনন্দ-বেদনাও সমানভাবে জড়িয়ে থাকে কবিতা কিংবা গানে। তাই হয়তো রোমান্টিকতায় ভরে ওঠা মানুষটি স্মৃতির শহরে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে, কখনো বা গলা ছেড়ে গায়তে থাকে- ‘দিন যায় কথা থাকে’ ‘তুমি যে আমার কবিতা’ ‘অনেক রোদ্র অনেক বৃষ্টি’ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া এমন অনেক দুর্দান্ত গান। তৎকালীন সিলেট বেতারে কোনো এক গানের প্রতিযোগিতায় অডিশন দেয়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল তার মিউজিক্যাল জার্নি। শুরুতে লোক সঙ্গীত এবং নজরুল সঙ্গীতে দীক্ষিত হলেও পরবর্তী সময় মিশে যান বাংলা আধুনিক গানের জগতে। ধীরে ধীরে গানের পাখি সুবীর নন্দী ডানা মেলেন আধুনিক গানের আকাশে। কে জানতো, একসময়কার জনতা ব্যাংকে কর্মরত মানুষটিই জাদুকরী সুরের মন্ত্রে মাতিয়ে তুলবেন বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ব্রিটেনের ‘হাউজ অব কমন্স’র থিয়েটার হলো। ১৯৭২ সালে ঢাকা রেডিওতে তার কণ্ঠে প্রথম রেকর্ড হয় ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ গানটি। প্লেব্যাক করা প্রথম সিনেমা আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’। ১৯৮১ সালে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’। ১৯৮৪ তে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘মহানায়ক’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে গান করার পর যার পিছনে তাকাতে হয়নি। শুভদা, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘের পরে মেঘ এমন সব যুগান্তকারী ফিল্মে প্লে-ব্যাক করায় অর্জন করেছেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। এমনকি তার ঝুড়িতে রয়েছে চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননাসহ অনেক পদক ও পুরস্কার। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে-তালে ভাব সাগরে ডুব দিয়ে নিজস্ব গায়কীতে সুরের মোহনায় যিনি আমাদের ভাসাতে এবং ভাবাতে জানেন তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি সুবীর নন্দী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App