×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ব মানবতার আনন্দের বড় উপলক্ষ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২০ পিএম

বিশ্বজুড়ে চলছে দুর্বলের ওপর সবলের জঘন্য নির্মমতা। হায়, কে থামাবে এই বর্বরতার রাশ! আসুন, আমরা এবার ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) দিবসে বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার মুক্তির জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে বিনীত প্রার্থনা জানাই। সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াই গর্জে ওঠা সমস্ত অপশক্তিকে।

বছর ঘুরে ফিরে এলো জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। মানবজাতিসহ সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য আজকের দিনটি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দের। কেননা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে সমগ্র ভুবনকে আলোকিত করে শুভাগমন করেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির অগ্রদূত মহানবী হজরত মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বিশ্ব যখন অন্ধকার ও অরাজকতায় ভরে যায়, তখনই অন্ধকার তাড়াতে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে দুনিয়ায় এলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয় নবী (দ.)। মহানবীর (দ.) শুভ আবির্ভাবের দিনটি সারা বিশ্বে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) হিসেবে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপনে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বা জশনে জুলুশ। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপনের অংশ হিসেবে অতীব আনন্দ সহকারে ইসলাম অনুমোদিত জশনে জুলুশ বের করা এবং এতে শামিল ও শরিক থাকা উত্তম আমল হিসেবে গণ্য। এতে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বাধা ও নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নই ওঠে না। যুগের পরিবর্তিত চাহিদা ও মানুষের রুচি-অভিরুচির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিষয়ে ইসলামের সায় ও সমর্থন রয়েছে। কোনো কর্ম বা আমল কারো জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত না হলে এবং তা ইসলামের বিধিবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে তাতে বাদ সাধার কোনো কারণ নেই। প্রিয় নবীর (দ.) জমানায় ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে জশনে জুলুশ প্রচলন ছিল না। এখন কেন জশনে জুলুশ? এই জিজ্ঞাসা যারা করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলা দরকার, ইসলামের সোনালি যুগে অনেক কিছুই তো ছিল না। সেই যুগে মসজিদে টাইলস ছিল না। বিদ্যুৎ ছিল না। পাখা ছিল না। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ছিল না। তাই বলে আজকের আধুনিক সভ্য যুগে এসে মসজিদে টাইলস, বিদ্যুৎ, পাখাসহ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নানা সুযোগ-সুবিধা আমরা কী উপেক্ষা করতে পারব? প্রিয় নবীর (দ.) যুগে বিমান-উড়োজাহাজ ছিল না। তাই বলে আজ আমরা কী বিমানে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করছি? অনেকেই বলেন, ‘জশনে জুলুশ’ বিদয়াত। মানে এটি ইসলামের নামে নতুন সংযোজিত একটি নিন্দনীয় কাজ। তাদের জানা দরকার বিদয়াত দুই প্রকার। বিদয়াতে হাসানাহ বা উত্তম নতুন প্রচলন। আর হচ্ছে বিদয়াতে সাইয়িয়াহ বা ইসলামের মোড়কে আপত্তিকর নতুন কোনো কিছু প্রবর্তন করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে লাখো লাখো নবীপ্রেমীর অংশগ্রহণে দেশ ও বিদেশে বর্তমানে যে ‘জশনে জুলশ’ বা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে তা অবশ্যই ‘বিদয়াতে হাসানাহ’ বা যুগের চাহিদার প্রেক্ষাপটে নতুন ইসলামি সংস্কৃতি। তাতে ইসলামের সায় ও অনুমোদন রয়েছে। যেহেতু এতে ইসলামবিরোধী বা জনঅকল্যাণকর কিছুই পাওয়া যায় না। অতএব ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উপলক্ষে আনন্দ খুশির স্মারক ‘জশনে জুলশ’ উদযাপনে কারো আপত্তি টেকে না। এতে ইসলামের অনুমোদন না থাকার কোনো বিষয় জড়িত নেই।

প্রিয় নবীর (দ.) দুনিয়ায় শুভাগমন আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে মানবজাতিসহ সৃষ্টি জগতের জন্য বিরাট অনুগ্রহ বা রহমতস্বরূপ। তাই তার শুভাগমনে ইসলাম অনুমোদিত পন্থায় খুশি উদযাপন করা অতি উত্তম আমল। কুরআন মজিদে আল্লাহ পাকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, হে হাবিব আপনি বলে দিন, আল্লাহ পাকের রহমত ও অনুগ্রহ প্রাপ্তিতে তাদের খুশি (ঈদ) উদযাপন করা উচিত। সেটাই হবে তাদের সঞ্চিত সমুদয় ধন-সম্পদ অপেক্ষা উত্তম (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫৮)

মহানবীর (দ.) মিলাদ বা জন্ম বৃত্তান্তের গুরুত্ব ও ফজিলত প্রসঙ্গে উম্মতশ্রেষ্ঠ সাহাবায়ে কেরামের আমল প্রমাণিত। ইসলামের প্রথম খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেছেন, যে মুমিন বান্দা প্রিয় নবীর (দ.) মিলাদ শরিফ উদযাপনে এক দিরহাম খরচ করল সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, যে বান্দাহ প্রিয় নবীর (দ.) মিলাদকে তাজিম ও সম্মান করল সে যেন ইসলামকেই জীবিত করল। (আন নিয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম পৃষ্ঠা-৭)

সত্যের মাপকাঠি সাহাবায়ে কেরাম পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে নিজেদের ঘরে প্রিয় নবীর (দ.) মিলাদ সংক্রান্ত আলোচনা করতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে একটি হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়। একদিন তিনি নিজ ঘরে প্রিয় নবীর (দ.) মিলাদ বা শুভ জন্মদিনের আলোচনা করছিলেন। তা দেখতে পেয়ে খুশিতে উৎফুল্ল প্রিয় নবী (দ.) বললেন, তোমাদের জন্য পরকালে আমার সুপারিশ ওয়াজিব (অবধারিত) হয়ে গেল। (ইবনে দাহিয়্যাহ আত তানভির ফিল মাওলিদিল বাশিরিন্নজির, পৃষ্ঠা ৭৭)। এভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদযাপনের বৈধতা কুরআন-হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত। তাই এতে আপত্তি তুলে বর্জনের কোনো সুযোগ নেই।

১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবীকে (দ.) ঘিরে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম থেকে ১৯৭৪ সালে সূচিত বড় আয়োজনের জশনে জুলুশ আজ বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছে। গাউসে জমান হিজরি পঞ্চদশ শতকের মুজাদ্দিদ (ধর্মীয় সংস্কারক) আল্লামা হাফেজ ক্বারি সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহের (রহ.) নির্দেশে চট্টগ্রাম নগরের কোরবানিগঞ্জ বলুয়ার দীঘি খানকাহ হতে শাহসুফি নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর (রহ.) নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে যে জশনে জুলুশের সূচনা তা আজ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও বিশ্ব সেরা জশনে জুলুশের অভিধা পেয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট আয়োজিত এ জশনে জুলুশের নেতৃত্ব দেন গাউসে জমান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)। এরপর ১৯৮৭ সাল থেকে অন্তত ৩২ বার জশনে জুলুশের নেতৃত্ব দিয়েছেন আওলাদে রাসুল (দ.) রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মজিআ)। এবার ২০১৮ সালে জশনে জুলুশ ৪৬ বছরে পদার্পণ করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশ ও বিশ্বের সবখানে আজ বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হচ্ছে জশনে জুলুশ। জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্বের সেরা ভাষণের তালিকায় স্থান দিয়েছে। প্রতি বছর চট্টগ্রামে ১২ রবিউল আউয়াল দিবসে ৩০/৪০ লাখ নবীপ্রেমী জনতার উচ্ছ্বাসমুখর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা ‘জশনে জুলুশ’ বিশ্ব ঐতিহ্যের (World heritage) স্বীকৃতি পাবার দাবিদার- তা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। জশনে জুলুশের জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি এখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এবার ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এসেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা দুর্যোগ ও ঘনঘটার মধ্য দিয়ে। অনেক দেশে নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের নিষ্ঠুরযজ্ঞ চলছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আজ বৈশ্বিক আতঙ্ক। ইসলামের নামে গর্জে ওঠা জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বে উদ্ধত ফণা তুলছে। ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ মুসলিম দেশগুলোতে নিরীহ মানবতা আজ ডুকরে কাঁদছে। আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমার কেবল মুসলমান হওয়ার অপরাধে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমন-নিপীড়ন-বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ বাধাহীনভাবে চলছেই।

অথচ দেশটির জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ বা শক্তিধর মোড়ল দেশগুলো তেমন দৃশ্যমান কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারছে না। বিশ্বজুড়ে চলছে দুর্বলের ওপর সবলের জঘন্য নির্মমতা। হায়, কে থামাবে এই বর্বরতার রাশ! আসুন, আমরা এবার ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) দিবসে বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার মুক্তির জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে বিনীত প্রার্থনা জানাই। সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াই গর্জে ওঠা সমস্ত অপশক্তিকে। আসুন, প্রত্যেকে আরো মানবিক, সহনশীল ও দায়িত্বপরায়ণ হয়ে দেশ ও বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মহানবীর (দ.) জীবনাদর্শ অনুসরণে আসুন দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করি।

আ ব ম খোরশিদ আলম খান : সাংবাদিক, ইসলামী চিন্তাবিদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App