×

মুক্তচিন্তা

পরিবর্তিত জলবায়ু এবং সূর্যালোকের স্বল্পতা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৭ পিএম

অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ নিঃসন্দেহে ঢাকা শহরের মেঘাচ্ছন্নতা বাড়াতে তথা সূর্যালোকের স্থায়িত্ব কমাতে প্রভূত অবদান রাখছে। আইপিসিসি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এড়াতে সমাজের সবক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন অপরিহার্য। সুতরাং বাংলাদেশের নগরায়ন, শিল্পায়ন, জ্বালানির ব্যবহার, শিল্প প্রযুক্তি, ভবন নির্মাণ কৌশল, পরিবহন ব্যবস্থা এবং আমাদের সার্বিক জীবনযাপন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বায়ুদূষণসহ সব প্রকার দূষণ রোধ করে একটি পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

গত ৮ অক্টোবর জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী প্রায় দেড় দশকের মধ্যে পৃথিবীতে খরা, বন্যা, ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ইত্যাদি মহাবিপর্যয় রূপে দেখা দিতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২০৩০ থেকে ২০৫২ সালের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। আমাদের জন্য অতীব উদ্বেগের বিষয় এই যে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। তবে ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে ১ম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ এখন অবস্থান করছে ৬ নম্বরে।

মুখ্য বিষয় হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার মেঘাচ্ছন্নতা যা ক্রমশ উদ্বেগের কারণে পরিণত হচ্ছে। তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন উপকরণগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও মেঘাচ্ছন্নতা বা সূর্যালোকের স্থায়িত্ব নিয়ে তেমন কোনো পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ দেখা যায় না। মেঘাচ্ছন্নতা পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে দিবাভাগে সূর্যালোক প্রাপ্তি বা মোট সূর্যালোকের স্থায়িত্ব বা মোট সৌরঘণ্টাকে বিবেচ্য ধরে দেখা যায়, ঢাকা শহরে মাসিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব বা সৌরঘণ্টা জুলাই মাসে ৪.৮ ঘণ্টা থেকে শুরু হয়ে মার্চ মাসে ৮.১ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ঢাকা শহরের বিগত ১৯৭৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৪০ বছরের মাসিক গড় সৌরঘণ্টার তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, সবচেয়ে কম সৌরঘণ্টা সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিরাজমান থাকে যা যথাক্রমে ৪.৮ থেকে ৫.৩ ঘণ্টা। বছরের বাকি সব মাসেই মাসিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব ৭ ঘণ্টার বেশি হয়ে থাকে, যেখানে মার্চ ও এপ্রিল মাসে তা ৮ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত বিগত ৪০ বছরের দৈনিক সৌরঘণ্টার উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত শতাব্দীর শেষ ২৫ বছরের তুলনায় বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ১৫ বছরে ঢাকার দৈনিক সৌরঘণ্টার পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সৌরঘণ্টা কমেছে ডিসেম্বর, জুন এবং জানুয়ারি মাসে যা যথাক্রমে প্রায় ২৯, ২৭ এবং ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আমাদের দেশে প্রচলিত মৌসুমওয়ারী সূর্যালোকের স্থায়িত্ব পরিবর্তনের চিত্র থেকে দেখা যায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রাক-মৌসুমি মাসগুলোতে বিগত শতকের শেষ ২৫ বছরের তুলনায় ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দৈনিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব কমেছে তবে তা খুব নগণ্য। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে দৈনিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব কমেছে তবে অন্যান্য মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে কমেছে সবচেয়ে বেশি, যা আগের সময়ের চেয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা কম। দৈনিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব কমার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে শীত মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে দৈনিক গড় সূর্যালোকের স্থায়িত্ব আড়াই থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত কমার রেকর্ড রয়েছে। গোলাকার পৃথিবীতে অক্ষাংশের ওপর ভিত্তি করে সূর্যরশ্মি কোথাও লম্বভাবে আবার কোথাও তীর্যকভাবে পড়ে। এ ছাড়াও পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে সূর্যকিরণ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয় এবং সঙ্গত কারণেই তাপমাত্রার পার্থক্য ঘটে। বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশে কখনো কখনো তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি পর্যন্ত উঠে যায়। বর্ষার সময় আকাশে প্রচুর মেঘ জমে থাকার কারণে মাটি থেকে সূর্যালোক থেকে প্রাপ্ত বিকীর্ণ তাপের যে তরঙ্গগুলো বড় মাপের সেগুলো মেঘের বাধা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বাকাশে ফিরে যেতে পারে না। ফলে মেঘলা দিনে বা রাতে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ তাপের একটা অংশ মেঘ ও মাটির মধ্যকার বায়ুমণ্ডলে আটকে পড়ে এবং বাতাসের স্তর বেশ গরম হয়ে থাকে। এতে বাস্পীভবন বাড়ে এবং বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকায় গরম বেশি অনুভূত হয়, মানুষের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম নিঃসৃত হয় ও অস্বস্তি বেড়ে যায়। আমাদের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহের পর বর্ষা কিছুটা হলেও প্রশান্তির পরশ নিয়ে আবির্ভূত হয়। বর্ষা ঋতুর আগমনে পুরো প্রকৃতি তার রূপ, বর্ণ, গতি, ছন্দ বদলে ফেলে। মাটি, গাছপালা, পশুপাখি সবকিছুই যেন বর্ষাস্নানে পরিতৃপ্ত হয়। মৌসুমি বায়ুর বহতায় প্রকৃতি ও প্রাণীর অন্তর জুড়িয়ে দেয় শীতল বাতাস আর বৃষ্টিমাখা বায়ুস্তর, প্রাণান্ত শান্তির পরশ ফিরে আসে আমাদের সামাজিক জীবনে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এগুলো কাব্যের মতো শোনালেও বাস্তবতা এই যে, বৃষ্টির ঘনঘটাপূর্ণ বর্ষায় এখন ভোগান্তির ছন্দ মিশ্রিত হয়েছে। বৃষ্টির তোড়ে ও জলাবদ্ধতায় ঘরের বাইরে বের হওয়া অনেক সময়ে চরম দুর্ভোগ বয়ে আনে। কাজে ব্যাঘাত ঘটায় কমে যায় দিনমজুরের আয়-উপার্জন। কাজেই সূর্যালোকের স্থায়িত্ব বা মেঘাচ্ছন্নতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। মানুষের স্বাস্থ্য, কর্মস্পৃহা ও কর্মদক্ষতা, দৃষ্টিসীমা, খাদ্যাভ্যাস, সালোকসংশ্লেষণ, উদ্ভিদে র বিস্তার ও বৃদ্ধি, স্বল্প ও দীর্ঘদিবসী উদ্ভিদের ফলন, মাছের বৃদ্ধি ও প্রজনন, বজ্রমেঘের উৎপত্তি ও গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি সূর্যের আলোর স্থায়িত্ব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। বায়ুর দূষক ও তার ধরন, ধুলা, মেঘ, গ্রিনহাউস গ্যাস, ভূ-উপরস্থ আলোর প্রতিফলন, আলোর শোষণ ও বিচ্ছুরণ, দিবাভাগের সময় ও মৌসুম, অক্ষাংশ, ভূপৃষ্ঠে পতিত আলোর কোণ, কুয়াশাচ্ছন্নতা ইত্যাদি সূর্যের আলোর স্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে থাকে।

বাংলাদেশের তাপমাত্রার রেকর্ড অনুযায়ী বিগত ১৩৭ বছরের সব এপ্রিল মাসের তুলনায় দ্বিতীয় উষ্ণতম মাস ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস যার রেশ মে অবধি বিরাজমান ছিল। এপ্রিল মাসের প্রচণ্ড তাপদাহের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়া অর্থাৎ এল-নিনো ঘটনার একটি যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের উন্মত্ততায় ঘটা নব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে এ বছরের এপ্রিল ও মে মাসে শতাধিক প্রাণহানি ঘটে। এই মৃত্যুসংখ্যা দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী আরো বেশি। তদুপরি ২০১৬ সালের এপ্রিলই ছিল সবচেয়ে বেশি উষ্ণ এবং বর্তমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ধারণা করা যায় এটি আসন্ন বছরগুলোতে আরো বাড়তে থাকবে। আবার, বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ভারতের দিল্লির পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান মনিটরিং স্টেশন এবং নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের পর্যবেক্ষণকৃত উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, গাজীপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামের বাতাসে পিএম১০ ও পিএম২.৫ এর মাত্রা সহনীয় পর্যায়ের চাইতে অনেক বেশি। উল্লেখ্য, ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫ সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বেশি। এগুলোর বাইরে ওজোন, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডসগুলোও বায়ুদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৃষ্টিহীন নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মূলত এই দূষণগুলো বেশি ঘটছে। ইটভাটা, গাড়ি ও কলকারখানার ধোঁয়া, ইমারত ও রাস্তা নির্মাণকাজ, পাহাড়ের ঢালে গাছ পুড়িয়ে চাষের জমি তৈরি ইত্যাদি এই দূষণে ভূমিকা রেখে চলেছে। উল্লিখিত দূষণের সঙ্গে শীতকাল চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই মেঘ থেকে ভূমিতে পতনযোগ্য বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ার একটি সুনিবিড় সম্পর্ক আছে।

এই অতিমাত্রায় বায়ুদূষণ নিঃসন্দেহে ঢাকা শহরের মেঘাচ্ছন্নতা বাড়াতে তথা সূর্যালোকের স্থায়িত্ব কমাতে প্রভূত অবদান রাখছে। আইপিসিসি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এড়াতে সমাজের সবক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন অপরিহার্য। সুতরাং বাংলাদেশের নগরায়ন, শিল্পায়ন, জ্বালানির ব্যবহার, শিল্প প্রযুক্তি, ভবন নির্মাণ কৌশল, পরিবহন ব্যবস্থা এবং আমাদের সার্বিক জীবনযাপন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বায়ুদূষণসহ সব প্রকার দূষণ রোধ করে একটি পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

ড. এম এ ফারুখ : শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App