×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন শেয়ার বাজারে প্রভাব ফেলার কথা না

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:২০ পিএম

বাংলাদেশে যে দুটি দলের ভেতর অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতার হাত বদল হয়ে থাকে, এদের উভয়ের আর্থিক নীতি একই। উভয়েই উদার মুক্তবাজার অর্থনীতির একনিষ্ঠ অনুসারী। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে দুদলের উল্লেখযোগ্য সদস্য রয়েছে। অতএব নির্বাচনে যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে আর্থিক নীতির এমন কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই যা শেয়ার বাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

জন্মলগ্ন থেকে শেয়ার বাজার স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যে কোনো রাষ্ট্রীয় ঘটনা বিশেষ করে সরকারের পরিবর্তন বা এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে। সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। দীর্ঘদিন কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ছিল না। ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের প্রথম পুঁজি বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন অবশ্য বাংলাদেশসহ বহু দেশে এসইসি রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি তুঙ্গে। কোম্পানির কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা অনেক বেড়েছে। তারপরও শেয়ার বাজারের অস্থির ভাবটা তেমন কমছে না। সবচেয়ে বড় কথা শেয়ার ব্রোকাররা পরিস্থিতি ধৈর্য ধরে বিশ্লেষণ করতে চান না। ২০০৪ সালে ভারতে বাম জোটকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করল। সঙ্গে সঙ্গে মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে এমন ধস নামল, যে বাজার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অথচ চলমান অর্থনীতির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। বামদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন সাধারণত একটি দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি শুধু তার নিজের ক্ষমতার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। বিভিন্ন দাতাসংস্থা রয়েছে। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও একটি দেশের নীতি সংশ্লিষ্টদের নিরীক্ষাধীন, অতএব চটজলদি আর্থিক নীতির পরিবর্তন আনা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কিছু বিবেচনায় আনতে হয়। এখন আসি আমাদের দেশের কথায়। বাংলাদেশে যে দুটি দলের ভেতর অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ক্ষমতার হাত বদল হয়ে থাকে, এদের উভয়ের আর্থিক নীতি একই। উভয়েই উদার মুক্তবাজার অর্থনীতির একনিষ্ঠ অনুসারী। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে দুদলের উল্লেখযোগ্য সদস্য রয়েছে। অতএব নির্বাচনে যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে আর্থিক নীতির এমন কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই যা শেয়ার বাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে দুবার নির্বাচনের পর শেয়ার বাজারে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। ঘটনাচক্রে দুবারই একই দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সময় ঘটে। সে সময় স্টক এক্সচেঞ্জের কাঠামোগত কিছু ত্রুটি ছিল। যদিও বলা হতো যে স্টক এক্সচেঞ্জ একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, বস্তুত এটি ছিল অনেকটা প্রাইভেট মেম্বার্স ক্লাব। প্রভাবশালী সদস্যরা একে যেভাবে চালাতেন, সেভাবেই পরিচালিত হতো। করপোরেট প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না ভিআইপি সদস্যরা যা বলতেন সেটাই হতো নীতি বা আইন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেউ ছিল না। যে কারণে ১৯৯৬-এর পরে ২০০৯-২০১০ সালে লাখো সাধারণ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যান।

অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত রোগটা ধরে ফেলেন। দুটো স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজ করা হয়। এর বিশদ ব্যাখ্যা এই স্বল্প পরিসরে দেয়া সম্ভব না, তবে সংক্ষেপে বলা চলে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা এখন সংখ্যালঘিষ্ঠ। চেয়ারম্যানও স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য নন। নিরপেক্ষ পূর্ণ করপোরেট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অনেক ব্রোকারকে বিধি ভঙ্গের জন্য জরিমানা করা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) যথাযথ সুপারভিশনের কাজ চালাতে পারছে। এ স্টক এক্সচেঞ্জ যখন মেম্বার ক্লাব ছিল, তখন এসব চিন্তা করা যেত না। রাজনৈতিক প্রভাব এবং তদবির সব সংস্কার কাজের অন্তরায় ছিল। এখন যদি বিএসইসি আন্তরিক থাকে তাহলে জনস্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে কোনো অসুবিধা হবে না। বিএসইসি সদা সতর্ক থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয় আসার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ফলে আজ চীনের মতো দেশকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পাশে পাওয়া গেছে। শেয়ার বাজার স্থিতিশীল একটা কথা বলা হয়ে থাকে যে লেনদেন তো বাড়ছে না। প্রথমত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজারে নিয়ে এসে তাদের গলাকাটার সুযোগ কমে গেছে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছেন এবং আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ হলো আইপিওতে আবেদন করা। কিন্তু আইপিওর সংখ্যা খুবই কম। শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য বিএসইসি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী খুঁজছে। এখন আইসিবি অনেক টাকা বিনিয়োগ করবে। এতে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হবে, শেয়ারের দাম বাড়বে, বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। যাকে বলা হয় ভার্টিকেল উন্নতি। এক সময় যা পড়তে বাধ্য। আমরা আইপিওর আগমনকে হরাইজন্টাল অগ্রগতি বলতে পারি। সেদিকে বিএসইসির অধিক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। শেয়ার বাজারের প্রাণ ধরা হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীকে। কিন্তু বর্তমানে আইপিওতে কোটা এবং কর্তৃপক্ষের বুকবিল্ডিং প্রীতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য পাওনাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ দিকটা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বে নন্দিত। অনেক সামাজিক এবং আর্থিক সূচিতে আমরা ভারত এবং পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। তবে এই অর্জন সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতের। কৃষিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে কৃষককুলের নিরলস প্রচেষ্টায়। সেই সঙ্গে সরকারের প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানও প্রশংসার দাবি রাখে। পোশাক শিল্পে একদিকে যেমন আমাদের শ্রমিকরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তেমিন মালিকরা সংস্কার এবং উন্নয়ন এনেছেন কারখানায়। শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীর সঙ্গে অন্য বিনিয়োগকারীর একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন যারা সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে থাকেন, তারা এটা জেনেই করেন যে বর্ষশেষে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের মুনাফা তারা পাবেন। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের পরিস্থিতিটা ভিন্ন। এখানে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী একটা বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে আসেন। অর্থাৎ দাম বাড়লে বিক্রয় করে সেই অর্থ আবার বিনিয়োগ করবেন। কারো কারো এরকম ধারণা যে শেয়ার কেনাবেচা করে খুব দ্রুত ধনী হওয়া যায়। এরকম কেনাবেচার ফাঁদে পড়ে অনেকে লোকসানের মুখে পড়েন। এই লোভ সংবরণ করতে হবে। প্রখ্যাত মার্কিন কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ মি. গলব্রেইথ খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মূল কারণ অন্তহীন লোভ। পরিশেষে আবার বলব যে একাদশ সংসদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক। তবে এর ফলাফলে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হবে না পুঁজিবাজারে।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও সাবেক সচিব, ডিএসই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App