×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন নিয়ে যত কথা আছে যত সংশয়

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:২৯ পিএম

কামাল হোসেনের সঙ্গে ফ্রন্ট করে বিএনপি খুশি। ফ্রন্টের শরিক না হলে তারা গণভবনে আলোচনায় অংশ নিতে পারত কিনা সন্দেহ। জামায়াত এবং জামায়াতবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিএনপি যে সমন্বয় বা ভারসাম্য তৈরি করেছে, সেটা দেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্য শুভ না হলেও বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারে। তবে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেমন সন্দেহ-সংশয় আছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন ও অবিশ্বাস আছে।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমে নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেও পরে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ কিছু রাজনৈতিক দল ও জোটের নির্বাচন পেছানোর দাবির কারণে ৩০ ডিসেম্বর তারিখ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য ঐক্যফ্রন্ট এক মাস পেছানোর পক্ষে জোর সওয়াল করেছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন না পেছানোর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, নির্বাচন হবে ৩০ ডিসেম্বর।

বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয় ছিল। তারা সাত দফা দাবি দিয়ে বলেছিল, ওগুলো না মানলে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়। সাত দফায় ছিল সংসদ ভেঙে দেয়া, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ। এর কোনোটাই সরকার মানেনি। আগে থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল যে সংবিধানের সঙ্গে যায় না এমন কিছুই সরকার করবে না। তবে সরকার নমনীয়তা দেখিয়েছে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে।

ড. কামাল হোসেন আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিলে প্রধানমন্ত্রী সেটা বিবেচনায় নেন। গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বৈঠকের ফলে রাজনীতিতে যে গুমোট ভাব ছিল তা কেটে যেতে থাকে। বিএনপির সামনে নির্বাচনে অংশ নেয়া ভিন্ন অন্য কোনো বিকল্প নেই। গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিকভাবে ঝুলন্ত অবস্থায়। বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বির্বাচনকেন্দ্রিক দল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয় এই জেদ নিয়ে বসে থেকে বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করার কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও করেও বিএনপি নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেনি। একতরফা এবং বিতর্কিত একটি নির্বাচন করে সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না বলে ভেবেছিল বিএনপি।

বিএনপির এই ভাবনাও সঠিক হয়নি। সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে নতুন নির্বাচনে যাচ্ছে। এই পাঁচ বছরে বিএনপির রাজনৈতিক অর্জন বলতে গেলে জিরো। তবে শেষদিকে এসে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করতে পারা বিএনপির একটি সাফল্য। বিএনপি এখন দুটি রাজনৈতিক জোটে আছে। একটি ২০ দলীয় জোট। অন্যটি যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টে শরিক দলগুলো এতদিন জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত ছিল। বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ তারা দিয়েছিল। বিএনপি জামায়াত ছাড়েনি। কারণ বিএনপির সামনে রয়েছে ভোটের হিসাব। জামায়াতের ভোট আছে বলে বিএনপির কাছে তার কদর আছে এবং থাকবে। তবে জামায়াত নিবন্ধনহীন দল হওয়ায় দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। এখন শোনা যাচ্ছে, জামায়াত বিএনপির সঙ্গেও নির্বাচনী আঁতাত করবে, আবার স্বতন্ত্রভাবেও ভোট করবে। অর্থাৎ নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াত সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, যদিও তাদের থাকার কথা সবচেয়ে খারাপ। বিএনপির সহযোগিতা-পৃষ্ঠপোষকতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবার জামায়াত কামাল হোসেন-কাদের সিদ্দিকী-মাহমুদুর রহমান মান্নার সহযোগিতাও পাবে।

বিএনপির ইমেজ সংকট দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন কামাল হোসেন। হাওয়া ভবনের অপবাদ, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি কিছুটা চাপের মধ্যে ছিল। কামাল হোসেন তার সততার ইমেজ দিয়ে বিএনপির কালিমা ঢেকে দিতে সহায়তা করলেন। কামাল হোসেনের সঙ্গে ফ্রন্ট করে বিএনপি খুশি। ফ্রন্টের শরিক না হলে তারা গণভবনে আলোচনায় অংশ নিতে পারত কিনা সন্দেহ। জামায়াত এবং জামায়াতবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিএনপি যে সমন্বয় বা ভারসাম্য তৈরি করেছে, সেটা দেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্য শুভ না হলেও বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারে।

তবে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেমন সন্দেহ-সংশয় আছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন ও অবিশ্বাস আছে। বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’। আন্দোলনের অংশ হিসেবেই বিএনপি আবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেবে কিনা সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আছে। বিএনপি জানে সরকার হারার জন্য নির্বাচন দেয়নি। সরকার জিতলে তারা হারবে। কিন্তু বিএনপিতে কেউ কেউ আছেন, যারা বিরোধী দল হতে চান না। হয় সরকারে, নয় তো নির্বাচন নয় অথবা নির্বাচনকে বিতর্কিত করা। বিএনপি যে সেরকম তৎপরতায় আছে সেটা বোঝা গেছে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে শোডাউনের নামে হাঙ্গামা বাধানো, আগুন দিয়ে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা থেকে। কেউ কেউ মনে করছেন, বিএনপি ১৪ নভেম্বর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে, পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে সবার কাছে এই বার্তাই দিয়েছে যে, তারা হাতের পাঁচ হিসেবে আগুনকে সঙ্গেই রাখছে। প্রয়োজনে জ্বালাও-পোড়াও করতে তারা পিছপা হবে না। সরকার বা আওয়ামী লীগ তার অবস্থান সংহত করুক- সেটা বিএনপি চায় না, চাইবে না। তাই সরকারকে বিপাকে বা বেকায়দায় ফেলতে তক্কেতক্কে থাকবে। যখন যে সুযোগ সামনে আসবে, সেটারই সদ্ব্যবহার করতে চাইবে। এতে একটি টেনশন সারাক্ষণই থাকবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা দেখে তাহলে তাদের ভূমিকা হবে এক রকম আর পরাজয়ের আশঙ্কা শুরুতেই স্পষ্ট হলে তারা নানা ছুতানাতায় পানি ঘোলা করতে চায়। শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে যদি বড় কোনো ঝামেলা না হয়, জামায়াতের সঙ্গে যদি সমঝোতা ঠিকমতো হয়, তাহলে বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ স্বস্তি তৈরি হবে। কিন্তু এটাই শেষ নয়। তারপর দেখার থাকবে আরো অনেক কিছু।

আবার আওয়ামী লীগ কীভাবে মাঠ ও ঘর গোছায় তার ওপরও নির্ভর করবে কিছু বিষয়। ঘরের শত্রুর ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবার কিছুটা সিরিয়াস বলেই মনে হয়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হলে তাকে দল থেকে চিরদিনের জন্য বহিষ্কারের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নিজে। তবে এই হুঁশিয়ারিতে কাজ কতটুকু হবে তা নিয়ে কারো কারো মনে সন্দেহ আছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কিছু মৌলিক সমস্যা আছে। দলের ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীরা যথাযথ মূল্যায়িত না হওয়ার অভিযোগ সব সময় শোনা যায়। সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী, হাইব্রিডরা কীভাবে যেন জাঁকিয়ে বসে। খন্দকার মোশতাকরা নিরাপদ আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। তাজউদ্দীনরা হন উপেক্ষিত।

শেখ হাসিনাকে একা এবং এক হাতে সব কিছু সামলাতে হয়। ফলে তিনি সব সময় মানসিক চাপে থাকেন। তার নিশ্চয়ই একটি উপদেষ্টামণ্ডলী এবং কাজের বিশ্বস্ত টিম আছে। বলা হচ্ছে, পাঁচ/ছয়টি জরিপের ভিত্তিতে এবার প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে। যাদের মনোনয়ন দেয়া হবে তারা যে দলের বৃহত্তর স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা দেয়া যাবে কি? আওয়ামী লীগের জন্য আগামী নির্বাচনে সহজ জয় অপেক্ষা করছে বলে যারা মনে করছেন তারা মাঠের বাস্তবতা খুব বিবেচনায় নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। টানা দশ বছর সরকারে থাকার ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি খারাপ দিকও আছে। মানুষ এক দলের টানা শাসন পছন্দ করে না। টানা শাসন একদিকে যেমন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, অন্যদিকে তেমনি সুশাসন ব্যাহত করে। গোষ্ঠী শাসনের সুযোগ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রচলিত একটি ধারণা এই যে, দলটি বন্ধুদের সঙ্গে ‘প্রপার বিহেভ’ করতে পারে না। আমাদের দেশে গণতন্ত্র যে সবল ভিত্তি পাচ্ছে না, তার একটি বড় কারণ প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দল গড়ে না ওঠা। আওয়ামী লীগের যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেককে বিচলিত, ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষুব্ধ করে তার জন্য দায়ী কিন্তু উপযুক্ত প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতি। বিএনপি-জামায়াতের মতো দলের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকলে আওয়ামী লীগের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে না। আগামী নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব বিস্তার করবে, সেটা বোঝার জন্য আমাদের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করতে হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App