×

বিনোদন

রুনা লায়লার চোখে একালের গান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০১৮, ০২:০৪ পিএম

রুনা লায়লার চোখে একালের গান
রুনা লায়লা। একজন কণ্ঠশিল্পী। একজন কিংবদন্তি। একজন আইডল। তিনি গানে গানে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। আজ এই নন্দিত তারকার জন্মদিন। সম্প্রতি রুনা লায়লা বর্তমান যুগের গান সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এ সময়ের গানের তুলনা টেনেছেন তার স্বর্ণসময়ের প্রেক্ষাপটের সঙ্গেও। পাঠকদের জন্য রুনা লায়লার সেই বক্তব্য তুলে ধরা হলো
আসলে প্রতিভা না থাকলে বড় শিল্পী হওয়া সম্ভব না। তবে প্রশিক্ষণচর্চাও অবশ্যই দরকার এবং এটা সারা জীবন ধরে দরকার। এখনো গানের চর্চা করি। তবে একেবারে নিয়ম মেনে চর্চা করা হয় না এখন। একটা বিষয় বুঝতে হবে, যত দিন যায়, নতুন নতুন গান আসে আর মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। ফলে আমাদের ওপর সব সময় এক ধরনের চাপ থাকে। আর সেই কারণে প্রতিনিয়ত নিজেকে আরো নতুন করে তৈরি হতে হয়। একই কারণে নিজের মধ্যে এক ধরনের তাড়না থাকে, আরো ভালো করতে হবে। মঞ্চ ছাড়া অন্য কোথাও গান করলে বা এখনো কোনো রেকর্ডিং করার সময় মনে হয়, অমুক জায়গা আরেকটু ভালো হলে বোধহয় ভালো হয়, ওই লাইন আরেকটু চেষ্টা করলে সম্ভবত আরো ভালো হবে ইত্যাদি। সেই কারণে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত ছাড়ি না। দিন দিন মানুষের চাহিদা বেড়ে যায়; তখন ভাবতে হয়, এর থেকে খারাপ আর করা যাবে না, বরং ভালো করতে হবে। সঙ্গত কারণে চাপও বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে বলি, অনেকে বলেন, আপনার এখনো টেনশন হবে কেন? আমি বলি, এখন আরো নার্ভাস লাগে। আগে অত লাগত না। কারণ আগে অত বুঝতাম না। দর্শক-শ্রোতা বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপটা বেড়ে গেছে। মানুষ এখন আমাকে কীভাবে নেবে, না জানি কী ধরনের দর্শক-শ্রোতা থাকেন, আমার গান তাদের পছন্দ হবে কিনা এসব ভাবতে হয়। এটা তো পাল্টে ফেলার উপায় নেই। যা হবে, একবারেই হবে। এ জন্য টেনশনটা বেশি লাগে। আমি এখন যদি স্টেজে ভুলভাল একটা গান গেয়ে আসি, লোকে বলবে, রুনা লায়লা আর আগের মতো নেই, শেষ। আমাদের সময়ে এমনো হয়েছে যে, রেকর্ডিং সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয়ে ভোর ৬টায় শেষ হয়েছে। একটা গানের রেকর্ডিংয়ে আগে দীর্ঘ সময় লাগত। লাহোরে এমনো হয়েছে যে, বড় বড় প্রোডাকশনে ১০০ থেকে ২০০ জন মিউজিশিয়ান দিয়ে গান রেকর্ড করা হতো। সবাইকে নিয়ে সবকিছু ঠিক রেখে একটা ‘পারফেক্ট টেক’ নেয়া ছিল কঠিন। এ সময়ে সবাইকে সমান তৎপর থাকতে হতো, যেন কারো কোনো ভুল না হয়। প্রথমদিকে মুম্বাইতে যখন লক্ষ্মীকান্ত- পেয়ারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি বা জয়দেবজির গান করেছি, সব লাইভ রেকর্ড হয়েছে পুরো অর্কেস্ট্রার সঙ্গে। এভাবে সবাই মিলে গাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। এখন গান কী, সুর কী, আমরা কিছুই জানি না। আগে তো দুই থেকে তিনদিন রিহার্সাল হতো সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে। পুরো অর্কেস্ট্রার সঙ্গে রিহার্সাল হতো। তারপর গান রেকর্ডিং হতো। তখন বোঝা যেত গানের কোথায় একটু ছাড়তে হবে, কোথায় যোগ করতে হবে, কোথায় কেমন অভিব্যক্তি হবে। অন্তত তিন-চারদিন ধরে আমরা এটা নিয়ে গবেষণা করতাম। তাতে আমরা ভীষণভাবে গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতাম। এখন গানের কথা ও সুর অনেক ক্ষেত্রে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা স্টুডিওতে যাই। একজনকে বলা হয় গান লেখো। ওইটার সুর করা হয়। আবার বলা হয়, আমরা লাইন লাইন করে নিয়ে নেব। শিল্পী এক লাইন করে গায়। এভাবে গান করা খুব সহজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গানের ক্ষেত্রে আমরা কোনো আবেগ পাচ্ছি না। এক লাইন করে গাইলে কোনো আবেদন তৈরি হয় না, অনুভ‚তি আসে না। সরাসরি গাওয়ার মধ্যে যে কঠিন ব্যাপার থাকে, সেটা এখন নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শেষ বিচারে দেখা যাচ্ছে, ওই সব পুরনো দিনের গানই কিন্তু মানুষ শুনছে। আর সেসব শিল্পীই টিকে যাচ্ছেন। এটা যে শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে তা না, এই উপমহাদেশে প্রায় একই প্রবণতা চলছে। আগে গান কম্পোজিশনের সময় প্রযোজক, পরিচালক, গীতিকার, এমনকি যার ওপর চলচ্চিত্রায়ন হবে, তিনিও থাকতেন। তখন একটা গানের জন্য অনেকের অংশগ্রহণ থাকত। এখন গানের কথা লিখে পাঠিয়ে দেয়। কখনো এসএমএস করে দেয়া প্রথম অন্তরা ওটা, এটা দ্বিতীয় অন্তরা ইত্যাদি। সবকিছু এত দ্রুততানির্ভর হয়ে গেছে, কারো আসলে সময় নেই। সবাই ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যে অনেক কিছু হলেও শিল্প কতটা হয়, সে প্রশ্ন সব সময় থেকে যায়। তবে এর মধ্যেও কিছু ভালো গান এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। অনেকে জাতীয় পুরস্কারও পাচ্ছেন। কিন্তু একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে। সেই অনুভ‚তিও নেই, সেই একাগ্রতাও অনেক কমে গেছে। এখন যার যার মতো এসে তার কাজ করে চলে যান। মিউজিশিয়ান আসেন। কেউ বেহালা বাজিয়ে চলে যান, কেউ বাঁশি বাজিয়ে চলে যান। কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না। আরো অদ্ভুত লাগে যে দ্বৈত গানের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয়, আমি হয়তো এখন গান গাইব, অথচ আমার সহশিল্পী কে, জানি না। ভারত-পাকিস্তানেও একই ঘটনা ঘটছে। আমি আমারটা গেয়ে চলে গেলাম। সহশিল্পী কে জানি না। পরে রেকর্ডিং বেরোলে বুঝি, ও আচ্ছা, আমার সঙ্গে ও গেয়েছে। পার্থক্য তো হয়ই। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এ রকম হচ্ছে। আসলে আমরা সবাই অলস হয়ে গেছি। কেউ পরিশ্রম করতে রাজি না। আমরা যেভাবে খেটেছি, সে রকমটা এখন কেউ ভাবেই না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App