×

জাতীয়

নাশকতার ছক জামায়াতের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০১৮, ১২:২৭ পিএম

নাশকতার ছক জামায়াতের
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ ছাড়ছে না বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেড়শ আসনে নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মনোনয়ন ফরম তুলেছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় থেকে জেলা নেতারা। আর নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে ভোটের মাঠে বিশৃঙ্খলার পরিকল্পনা করেছে দলটি। এ লক্ষ্যে তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও মাঠে নামানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। বিশেষ করে জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় কেন্দ্রভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াত-শিবির। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটের প্রধান বিএনপি যদি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চাপে জামায়াতকে গুরুত্ব না দেয় তবে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অবশ্য বিএনপির সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ধানের শীষ প্রতীকে নৌকা প্রতীক মোকাবেলা করতে চায় জামায়াত। এ জন্য তারা চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলার অর্ধশতাধিক আসনে নিজেদের ‘ভোটব্যাংক’ বিবেচনা করে হিসেব কষছে। এদিকে ভোটের মাঠে সুবিধা করতে না পারলে জামায়াত-শিবির গোপনে নাশকতার ছক কষছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই মধ্যে গোপনে বৈঠক ও নাশকতার প্রস্তুতির অভিযোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে যেভাবে ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল তার চেয়েও ভয়াবহ নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। ডিএমপির সূত্রমতে, গত কয়েক বছরে দায়ের হওয়া কমবেশি ৮০০ নাশকতার মামলার মধ্যে অন্তত ৫০০টিতে শিবিরের নেতাকর্মীরা আসামি হিসেবে আছেন। এসব মামলার আসামি ধরতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান রিপন বলেছেন, নির্বাচনের সময় জামায়াত-শিবির নাশকতা করতে পারে এমন আশঙ্কায় নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। গত ২৬ সেপ্টেম্ব^র রাজধানীর ওয়ারী এলাকা থেকে শিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে দেড়শ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের বরাতে মামলার এজাহারে বলা হয়, জামায়াত-শিবির বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নেয়ার জন্য গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। গ্রেপ্তারকৃতরা সে সময় পুলিশকে জানায়, তারা নাশকতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাসায় বিস্ফোরক দ্রব্য মজুদ করেছে। গত মাসের শেষদিকে চট্টগ্রাম নগরের দেয়ান বাজার, চকবাজার ও চন্দরপুরা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশের একটি দল চন্দরপুরার ডিসি রোডে শিবিরের কার্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। চারতলা ভবনের ছাদে ও ভেতরে চারটি বিস্ফোরণ ঘটায় শিবিরের ক্যাডাররা। পরে চারতলা ভবনটির তৃতীয় তলা থেকে ছয়টি ককটেল এবং ককটেল তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ। বিস্ফোরণের পরপরই চকবাজার, কোতোয়ালি ও সদরঘাট থানার কয়েকশ পুলিশ চারতলা ভবনটি ঘিরে ফেলে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটকে সঙ্গে নিয়ে রাত ৯টার দিকে আবারো ওই ভবনে প্রবেশ করে পুলিশ দেখতে পায়, ভবনটির পেছনে দুটি দরজা আছে। ওই দরজা দিয়ে শিবির নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় শিবিরের নগর উত্তরের সভাপতি আব্দুল জব্বার ও সাধারণ সম্পাদক আ স ম রায়হানসহ ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৯০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে সিরাজগঞ্জ জেলা আমির মাওলানা শাহীনূর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ছয় মাসে চট্টগ্রামে জামায়াতের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ছাত্রশিবিরের কয়েকশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ছাত্রশিবিরের ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ সংগঠনটির ১০ পৃষ্ঠার একটি নথি উদ্ধার করে। যেখানে ২০১৮ সাল অর্থাৎ নির্বাচনের বছরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কৌশলগত পরিকল্পনার পুরোটাই রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম নগরের ১৬টি থানা এলাকাকে ৫২টি সাংগঠনিক থানায় ভাগ করে কাজ শুরু করে ছাত্রশিবির। নির্বাচন সামনে রেখে এই ৫২টি সাংগঠনিক থানায় মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন ২৫৮ জন নেতা। তাদের অধীনে মাঠে থাকবে ২০ হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী। প্রতিটি ইউনিট থেকে আটজন করে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়ে গঠন করা হয়েছে সমন্বয় কমিটি। পুলিশের তথ্যমতে, শিবিরের সবচেয়ে মজবুত সংগঠন রয়েছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। এরপরই আছে সরকারি স্কুল ও কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ নির্বাচন ঘিরে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত দেশের সব শাখায় দিক-নির্দেশনামূলক একটি বক্তব্য পাঠিয়েছেন। যেখানে ২০টি দফার কথা উল্লেখ আছে। নির্বাচন নিয়ে ছাত্রশিবিরের পরিকল্পনায় সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নিজেদের বড় শক্তি হিসেবে প্রকাশের কথা সেখানে উল্লেখ রয়েছে। জামায়াতের মনোনয়ন নিলেন যারা : জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান (ঢাকা-১৫; মিরপুর-কাফরুল), মাওলানা আব্দুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও-২) মাওলানা আবু হানিফ (দিনাজপুর-১), মাও. আফতাব উদ্দিন মোল্লা (দিনাজপুর-৪), আনোয়ারুল ইসলাম (দিনাজপুর-৬), মাওলানা আব্দুস সাত্তার (নীলফামারী-১), অধ্যাপক মাজেদুর রহমান (গাইবান্ধা-১), মাওলানা নজরুল ইসলাম (গাইবান্ধা-৩), ড. কেরামত আলী (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১), অধ্যাপক ইয়াহইয়া খালেদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), নুরুল ইসলাম বুলবুল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), অধ্যাপক মুজিবুর রহমান (রাজশাহী-১), অধ্যাপক তাসনিম আলম (নাটোর-১), খ. ম. আবদুর রাকিব (নওগাঁ-৪), মাও. রফিকুল ইসলাম খান (সিরাজগঞ্জ-৪), অধ্যক্ষ আলী আলম (সিরাজগঞ্জ-৫), আলহাজ দবিবুর রহমান (বগুড়া-৫), ডা. আব্দুল বাসেত (পাবনা-১), অধ্যাপক আবু তালেব মন্ডল (পাবনা-৪), প্রিন্সিপাল ইকবাল হোসাইন (পাবনা-৫), মুহাম্মদ আবদুল গফুর (কুষ্টিয়া-২), মোহাম্মদ রুহুল আমিন (চুয়াডাঙ্গা-২), অধ্যাপক মতিয়ার রহমান (ঝিনাইদহ-৩), মাওলানা আজিজুর রহমান (যশোর-১), আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদত হোসাইন (যশোর-২), গাজী এনামুল হক (যশোর-৫), অধ্যাপক মুক্তার আলী (যশোর-৬), এডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ (বাগেরহাট-৩), অধ্যাপক আবদুল আলীম (বাগেরহাট-৪), অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার (খুলনা-৫), মাও. আবুল কালাম আযাদ (খুলনা-৬), অধ্যক্ষ ইজ্জতুল্লাহ (সাতক্ষীরা-১), মুহাদ্দিস আবদুল খালেক (সাতক্ষীরা-২), মুফতি রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), গাজী নজরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা-৪), শামীম সাঈদী (পিরোজপুর-১), ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ (পটুয়াখালী-২), অধ্যাপক জসিম উদ্দিন (ময়মনসিংহ-৬), কাজী দ্বীন মোহাম্মদ (কুমিল্লা-৬), ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের (কুমিল্লা-১১), মাস্টার রুহুল আমীন (লক্ষ্মীপুর-২), ডা. আনোয়ারুল আজিম (লক্ষ্মীপুর-৩), ডা. ফখরুদ্দিন মানিক (ফেনী-৩), আলহাজ শাহজাহান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), মাওলানা শামসুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৫), মাওলানা জহিরুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৬), হামিদুর রহমান আজাদ (কক্সবাজার-২) প্রমুখ। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর গত ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিজের নামে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারবে না। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আগে থেকে ভিন্নপথে হাঁটার পরিকল্পনা করছে জামায়াত-শিবির।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App