×

মুক্তচিন্তা

আরো দৃঢ় হতে হবে পদক্ষেপ

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৪০ পিএম

আরো দৃঢ় হতে হবে পদক্ষেপ
আরো দৃঢ় হতে হবে পদক্ষেপ

কর আদায় নয় কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে। তবে এ সব কিছুই নির্ভর করবে আয়কর আইনের ভাষা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ও কল্যাণপ্রদ পরিবর্তন আনয়নের ওপর।

বাংলাদেশে বিদ্যমান কর সংস্কৃতির বিকাশ ও বাস্তবায়ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ শুধু কর মেলা কিংবা মাস উদযাপনের সময়ে নয়, সবসময়ই রয়েছে। কেননা দেশের আয়কর দেয়ার প্রেক্ষাপট দ্রুত উন্নত ও কার্যকর হওয়া দরকার। বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত এখনো কম। এটি একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতিও নির্দেশ করে। জিডিপি এত হলে ট্যাক্স কম হয় কী করে? তার মানে মানুষ ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছে না। আহরিত রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর আয়করের অবস্থান এখনো তৃতীয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আহরিত মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬/৩৭ শতাংশ ভ্যাট, ৩৩/৩৪ শতাংশ কাস্টম ডিউটি (সম্পূরকসহ আমদানি শুল্ক) এবং ৩০/৩১ শতাংশ আয়করের অবদান। অথচ অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে, আয়কর হবে সর্বোচ্চ। অন্যগুলো থাকবে তারপরে। যে অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়, সম্পদ ভোগ করতে পারে- তারা কেন আয়কর দেবে না? আয়কর তৃতীয় অবস্থানে থাকবে কেন? অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের এ ধরনের নাজুক কাঠামোর কারণে স্বাধীনতার পর দেশ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ এবং প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার অনুদান গ্রহণ করেছে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ পাহাড় সমান। বিদেশি ঋণের আসলের বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ প্রায় দশ-এগারো কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ঋণের বার্ষিক সুদ পরিশোধে বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশই চলে যাচ্ছে। এ রকম একটি অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে খাতওয়ারি অসমাঞ্জস্যতাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে আয়কর পরিস্থিতি উন্নয়নের বিকল্প নেই। আয়কর যথাযথভাবে দেয়া হলে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত বাড়বে, অসামঞ্জস্যতাও দূর হবে। যে দেশের সাত লক্ষাধিক লোক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারে, মাসে শত শত গাড়ি আমদানি হয়, সেখানে আয়কর থেকে এত কম রাজস্ব আসতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

দেশে বিদ্যমান আয়কর আইন, এর কাঠামো এবং এর প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিই আজ বিশেষভাবে বিবেচ্য হয়ে উঠছে এ কারণে যে করদাতা আর কর আহরণকারীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন যত বাড়বে তত কর সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। কর আইনের রাজনৈতিক প্রয়োগ শুধু সাময়িক তিক্ততার সৃষ্টি করবে না দীর্ঘমেয়াদে অপপ্রয়োগের পথ উন্মোচিত হবে। আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয় কিংবা মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয় এই স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারটি বিশ্লেষণে গেলে এটা স্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হয় যে মানুষের কল্যাণেই আইনের প্রয়োজন। তবে মানুষ আগে আইন পরে। আইন মানুষকে মুক্তির জন্য, তাকে বন্দি করার জন্য নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার আইনের আওতায় স্বীকৃত, নিশ্চিত, নির্ধারিত, নিবন্ধিত হয়ে থাকে। মানুষ তার চিন্তার, বিশ্বাসের, শরীরের, দেহের, চলাচলের, সম্মানের ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও নিরাপত্তা দাবি করতে পারে আইনের কাছে। তাই যে কোনো আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সার্বজনীনতা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা এর একটি অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। নিবর্তনমূলক কিংবা প্রতিরোধাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি সঞ্জাত আইন কল্যাণপ্রদ আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। যে আইন যত সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য, সর্বজনবোধ্য, সর্বজন অনুসৃতব্য সে আইন তত কল্যাণকর, সে আইন তত কার্যকর।

করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধিবিধানের প্রয়োগের ভাষায় যদি কুটিল মনোভাবের প্রকাশ পায় তাহলে তা জটিল, দ্ব্যর্থ ও ক‚টার্থবোধক হয়ে ওঠে। এ দেশে প্রবর্তিত আয়কর সংক্রান্ত সার্কুলারসমূহে জটিলতা যুগলবন্দি হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক সরকারের তরফে করদাতা কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় না এলেও কর আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদার পাইক পেয়াদাসুলভ যুদ্ধাংদেহী মনোভাব প্রকাশ পেত। এখন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন দেশে করদাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রকাশ্যভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনাদানের বিষয়টি উদ্বেগজনক। এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সঙ্গে করদাতাদের সম্পর্ক জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে দোষারোপ আর এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হওয়ার প্রবণতা পরিব্যপ্ত হবে।

আয়কর ব্যবস্থা যেখানে সামাজিক সুবিচার ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে পারস্পরিক-পরিপূরক দায়িত্ব পালনের বিষয়, ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় সঙ্গত কারণেই যার যথার্থতা অনুসরণ ছিল অনুপস্থিত, আজকের বাংলাদেশ অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনামলে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ তথা আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপুল বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার ছিল তা কি এখনো অব্যাহত থাকবে?

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরও, এক যুগেরও বেশি সময় সেই ১৯২২ সালের আয়কর আইন ভারত স্থলে পাকিস্তান, পাকিস্তান স্থলে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপিত ও নামাঙ্কিত হওয়া ছাড়া একইভাবে বলবৎ ও প্রযোজ্য থাকে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬নং অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তবে তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগ যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বারবার দাবি উঠেছে আয়কর অধ্যাদেশের স্থলে আয়কর আইন প্রণয়নের। আইনসভার অনুমোদনে প্রণীত না হওয়ায় লক্ষ করা যায় অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারাসমূহ তথা বিধানাবলী মূলত ১৯২২ সালের মূল আইনেরই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রণীত প্রেসক্রিপশন মাত্র এবং এটি সে হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোঁটা শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন এবং মূল ধারণার আওতায় প্রয়োগ যোগ্যতার মাপকাঠির পরিবর্তন বা পরিমার্জন অনুমোদিত হয়েছে তা ধারণ করা ছাড়া ১৯২২-এর মূল আইনের ভাব ভাষা দৃষ্টিভঙ্গিগত তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃশ্যগোচর হয় না। বরং প্রতি বছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার আচার এ কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ-নিষ্কৃতি-ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে অনেক ক্ষেত্রেই করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃৃতিও সুবিধা সংক্রান্ত মৌল দর্শন হয়েছে বিভ্রান্ত, বিকৃত ও বিস্মৃত। পক্ষান্তরে, যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলী সহজীকরণ সরলীকরণ তথা করদাতা বান্ধবকরণের পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে আরো জটিল হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতির সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে আয়কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ সংবলিত সংশোধন সংযোজন-বিয়োজন প্রয়াস বারবার যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশের অর্থনীতি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অবগাহন করে অধুনা মনস্ক হতে চাইলেও সে দেশের আয়কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনো যেন ঔপনিবেশিক আমলের পারস্পরিক অবিশ্বাসের, সংশয় সন্দেহের, জটিলতার আবর্তে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নামে বরং আইনের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ার ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির পথপরিক্রমায়। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নিরুৎসাহিতবোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যমান আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সেই আইন প্রয়োগে অভ্যস্ত আয়কর বিভাগ এবং সেই আইনের আওতায় করদাতাকে সহায়তাদানকারী সমাজও তাদের মেধা ও বিজ্ঞ কৌশলেও সময়ের দাবির প্রেক্ষাপটে আন্তরিক হয়েও যথা সংস্কারে সফল অবস্থায় উত্তরণে গলদঘর্ম হয়। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার অর্থে ভাড়া করা দেশি-বিদেশি আয়কর বিশেষজ্ঞ দ্বারা বাংলাদেশের বিদ্যমান গোটা আয়কর আইনকে পুনর্লিখিত করে ইংরেজি ভাষায় প্রণীত খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বাংলাভাষা প্রয়োগ আইন পাসের পর দেশের সব আইন বাংলাভাষায় প্রণয়নের বিধান থাকলেও আয়কর আইনটি ইংরেজি ভাষায় দুর্বোধ্য ও দ্ব্যর্থবোধক প্রাকরণিক ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ার সমাহার ঘটানো হয়েছে যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সঙ্গত প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ দেশের আয়কর আইন হবে এ দেশেরই আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক, তবেই বাড়বে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং এর বাস্তবায়নযোগ্যতা।

এ কথা অনস্বীকার্য থেকে যাবে যে এই আয়কর আইনের ভাষা হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারি এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। করদাতা যেন নিজেই নিজের আয়কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত আয়কর দাতাগণ যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে আয়কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয় কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে। তবে এ সব কিছুই নির্ভর করবে আয়কর আইনের ভাষা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ও কল্যাণপ্রদ পরিবর্তন আনয়নের ওপর। আর সে প্রত্যাশা পূরণ প্রয়াসে আইন পরিষদ, নির্বাহী বিভাগ এবং করদাতা নির্বিশেষে সবার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক হবে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App