×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদাসীনতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৩ পিএম

বর্তমানে রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় গ্রহণ একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে। বার্মায় পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির এই কুফল প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের ও সংশ্লিষ্ট অনেককে বহুদিন পোহাতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বর্মী সেনা কর্তৃক নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্মূলের পরিকল্পনা পুরোদমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে এই চরম অমানবিক পরিস্থিতি কোনো জাতিগত বিদ্বেষের হঠাৎ বিস্ফোরণ নয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যতই থাকুক, এই গণহত্যা নিছক তার ফল নয়। এর পেছনের ছক মিয়ানমার রাষ্ট্রের তৈরি। গণহত্যার ছকটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনী কর্তৃক। আর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু কির নেতৃত্বে তা সফল সমাপ্তির পথে।

বার্মার রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ সংকট অনেক পুরনো। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিয়েও সেখানে সমস্যা আছে। তবে মুসলমান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা চরম নৃশংস রূপ লাভ করেছে। আধুনিক সর্বজনস্বীকৃত মানবাধিকারের সব ধারণাকে তা বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসকরা কোনো সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নির্মূলের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয় ও তার জন্য খেসারত দিতে হয়। মিয়ানমারের সৈন্যসমর্থিত শাসকরা তেমনি একটা নিশ্চিদ্র গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। ধর্মীয় পরিচয়ের পার্থক্যকে তারা ব্যবহার করছে সহায়ক শক্তি হিসেবে। আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর তা এক বিরাট চাপ তৈরি করেছে। বার্মার সেনাবাহিনী কর্তৃক এই নগ্ন গণহত্যা বিশ্বব্যাপী নিন্দার কারণ হয়েছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। শরণার্থী সমস্যা যেখানে বহু ধনী দেশের রাজনীতিতে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং একে কেন্দ্র করে অনেক দেশে সংকীর্ণ গোষ্ঠীতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ও ক্ষমতা দখল চলছে, সেখানে বাংলাদেশের মানুষের ও তাদের সরকারের মনোভাব মানবতার জন্য দৃষ্টান্তমূলক।

তবে বার্মার সেনাবাহনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এদিক থেকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ প্রায় নিষ্ক্রিয়।

ফলে বর্তমানে রোহিঙ্গারা গণহত্যা ও উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় গ্রহণ একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে। বার্মায় পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির এই কুফল প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের ও সংশ্লিষ্ট অনেককে বহুদিন পোহাতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে বর্মী সেনা কর্তৃক নির্বিচারে খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্মূলের পরিকল্পনা পুরোদমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে এই চরম অমানবিক পরিস্থিতি কোনো জাতিগত বিদ্বেষের হঠাৎ বিস্ফোরণ নয়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যতই থাকুক, এই গণহত্যা নিছক তার ফল নয়। এর পেছনের ছক মিয়ানমার রাষ্ট্রের তৈরি। গণহত্যার ছকটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনী কর্তৃক। আর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু কির নেতৃত্বে তা সফল সমাপ্তির পথে।

রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক মিয়ানমারের একটি মুসলমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর এই বর্বর আক্রমণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও বিশ্ব জনমতের কোনো তোয়াক্কা না করেই হচ্ছে। মিয়ানমারের আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর সুবিধা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে তারা এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর বাধার মুখে পড়েনি ও পড়ছে না। যেসব সমালোচনা হয়েছে ও হচ্ছে তা যেন গায়ে না মাখলেও তাদের চলে। সমালোচনা উঠছে ভুক্তভোগী বাংলাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার ও মানবতাবাদী সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ হিসাব-নিকাশের তালিকায় রোহিঙ্গা গণহত্যা নেই।

খ্যাতিমান লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান সম্প্রতি এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স নামের একটি জার্নালে ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: হোয়াই দ্য ওয়ার্ল্ড মাস্ট অ্যাক্ট ডিসাইসিভলি’ (৩ অক্টোবর ২০১৮) শীর্ষক একটি লেখায় সমস্যাটির নানাদিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

এতে এই আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের উদাসীন অবস্থা ও সংকটটির দীর্ঘমেয়াদি চরিত্রলাভের আশঙ্কাও ব্যক্ত হয়েছে। বিশ্ব শক্তিসমূহের আরো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি। এ ব্যাপারে বিশ্বে অনুরূপ আরো কিছু আলোচনার দিকে আগে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন মহাসচিব সলিল শেঠীর মতে, ‘সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস থেকে পালিয়ে ফেরা মানুষের প্রতি সরকারসমূহের এই উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশে আমাদের চোখের সামনে বিশ্বের দ্রুততম সংঘটিত শরণার্থী সংকটের পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে।’ (জাতিসংঘ : মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ শরণার্থী সংকট সমাধানে বিশ্বনেতাদের চরম ব্যর্থতার প্রকাশ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮) রাষ্ট্র নেতাদের কিছু বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের আবেগপরায়ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মূল হর্তাকর্তারা বলতে গেলে চোখ বন্ধ করে আছেন। তারা এমন ভাব করছেন যে তাদের হাতে এত সমস্যা, এর মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি উটকো ঝামেলা।

মানবতাবাদী সংস্থাসমূহের কাছে বিষয়টি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি অন্যান্য সমস্যা-সংকটকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। হাম্মাদ জামুরাদ লেখেন : ‘৭ লাখ মানুষকে শরণার্থী বানিয়েছে যে আক্রমণ তা বন্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর চাপ তৈরির জন্য অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার মতো একটি শক্ত বার্তা পাঠানোর পরিবর্তে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাসি কথার পুনরুৎপাদন হলো- যাতে কেবল রাগ প্রকাশ পেল, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নেই। যে নিরাপত্তা পরিষদ গণহত্যা, জাতি নির্মূল ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ঠেকাতে পারে না তা অকম্মার ঢেঁকি।’ (জাতিসংঘ যেভাবে রোহিঙ্গাদের হতাশ করল, গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস, ১৩ মার্চ ২০১৮)

গত বছর ডিসেম্বরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জায়েদ রাদ আল হুসেন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, অং সান সু কি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান মিন অং হ্লাইংকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। এ রকম একটি কঠিন মন্তব্যে বিশ্বব্যাপী একটা অসহনীয় নীরবতা ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সাইমন টিসডাল গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছেন, এই ঘটনা ‘এই সত্য দেখাচ্ছে যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রয়োজনীয় সমর্থন শূন্য।’ (রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে বিশ্বের অদ্ভুত নীরবতা, ৩ জানুয়ারি ২০১৮)

সম্প্রতি জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশন এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে মিয়ানমার সৈন্যবাহিনীর চরম হিংস্রতা ও নৃশংসতার প্রমাণ হাজির করেছে ও ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তাদের বিচার দাবি করেছে। এতে দেশটির সেনাবাহিনীকে স্পষ্টভাবে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংসহ ছয়জন সেনা কর্মকর্তার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড তদন্ত করে দেখার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা চাইলেও মিয়ানমারের গণহত্যাকারী নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আনার কাজটা সহজ নয়। কারণ বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্র অন্যখানে ও বিশ্ব নেতাদের মাথাব্যথা অন্যান্য বিষয়ে।

অতএব, সম্প্রতি সমাপ্ত জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারায় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে হতাশ করল। সাধারণ অধিবেশন আবারো খোশগল্পের আড্ডাখানায় ও ট্রাম্পের কৌতুক নাট্যের প্রদর্শনীতে পরিণত হলো। অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোচনায় প্রাধান্য পেল এবং অনেক অপ্রয়োজনীয় বাকযুদ্ধের মহড়া হলো।

সৈয়দ বদরুল আহসান এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে লিখেছেন : ‘রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বিশ্বকে অনতিবিলম্বে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংকট সমাধানে একটি বিশেষ বাধা হলো বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা, নিজ বাড়িঘরে ও গ্রামে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান, এবং সর্বোপরি মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের গ্রহণ ও স্বীকারের জন্য আইনি ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে অন্যদের সঙ্গে সম্মত হতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীনের অনিচ্ছা।’ লেখক ও সাংবাদিক আহসান এখানে আরো লিখেছেন, ‘বিশ্ব সম্প্রদায়ের আশা অনুযায়ী সমাধান করা না হলে রোহিঙ্গা সমস্যাটি এই অঞ্চল ও বিশ্বের বৃহত্তর ক্ষেত্রের জন্য আরো বড় মাত্রা লাভ করার দিকে গড়াবে।’

বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার কারণে রোহিঙ্গা সংকট ইতোমধ্যে জটিল আকার ধারণ করেছে। কিন্তু বিশ্বনেতারা এখনো সমস্যাটির প্রতি বলতে গেলে উদাসীন। কথার অমৃত ঢালা ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ নেই। আসলে বিশ্ব নেতাদের উদাসীনতাও একমাত্র বড় সমস্যা নয়। বড় সমস্যা হলো মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কয়েকটি বড় রাষ্ট্রের হীন স্বার্থের অশুভ সম্মিলন। হীন স্বার্থের এই অশুভ সম্মিলন বজায় থাকা পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘস্থায়ী কার্যকর সমাধান ধারাছোঁয়ার বাইরে থাকার সম্ভাবনা।

আলমগীর খান : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App