×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন যাত্রা নির্বিঘ্ন হবে তো?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৮ পিএম

এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু সব পক্ষের উচিত হবে, সরকারের সঙ্গে পাঞ্জা না লড়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের অঙ্গীকার পালনে বাধ্য রাখা। সরকার নয়, নির্বাচন পরিচালনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন যদি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে, তাদের ওপর সংবিধান যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে সেটা পালনের সক্ষমতা দেখাতে পারে তাহলে মানুষের মন থেকে অনেক সংশয় দূর হবে। দেশে নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে নিয়ম করে। ভোট দিলেও মার খেতে হয়, না দিলেও মারের হাত থেকে রেহাই নেই। সংখ্যালঘুদের মনে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা সেটা দূর করতে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোটের আগে-পরে সংখ্যালঘুরা নিজ বাসাবাড়িতে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। এই নির্বাচন নির্বিঘ্ন ও নিষ্কণ্টক হবে কিনা সে প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে কি সংঘাত-সহিংসতার পথে যাবে আর কয়টি রাজনৈতিক দল তাদের অনুসরণ করবে এসব প্রশ্ন উঠছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ‘সংসদ নির্বাচন ঘিরে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহের জাগরণ ঘটে। তাদের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাসে গোটা দেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে’। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ঠিক এই আবহাওয়ায় অনুষ্ঠিত হবে কিনা সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে কোনো ধরনের শঙ্কা থাকলে ‘স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহের জাগরণ’ ঘটবে কিনা নিশ্চিত নয়। তবে নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হোক, শান্তি বজায় থাকুক, দেশে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ১৯ নভেম্বর। বাছাই ২২ নভেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৯ নভেম্বর। আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট সাত দিন পেছানোর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু ‘মানি না, মানব না’ কেউ বলেননি। ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি এখন তফসিল বদলানোর জন্য আন্দোলন করবে কিনা, আন্দোলনের ধরন কি হবে, আন্দোলনের ডাক দিলে তাতে সাধারণ মানুষ সাড়া দেবে কিনা এসব নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ নেই।

শুধু এটুকু বলা যায় যে, দেশের মানুষ আন্দোলনের মুডে নেই। বিএনপিরও আন্দোলন করার প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা নেই। তাই বিএনপিকে এখন নির্বাচনের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দলটি এমনিতেই নির্বাচনী দৌড়ে পিছিয়ে আছে।

বিএনপির সাত দফা দাবির সবগুলো যে আদায়যোগ্য নয়- এটা তাদেরও না জানা থাকার কথা নয়। সংবিধানের সঙ্গে যায় না- তেমন কিছু যে সরকার মানবে না সেটা অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। তাছাড়া সরকার দাবি মানার মতো কোনো চাপের মধ্যেও নেই। বিএনপি কিসের জোরে বা ভরসায় ভেবেছিল যে সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হবে তা তারা এখনো স্পষ্ট করতে পারেনি। ‘বিদেশি’ শক্তির চাপে সরকার নতি স্বীকার করবে এটা যদি বিএনপির বিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হবে যে, বিএনপি খুব নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে শক্ত খেলা খেলতে নেমেছে।

বিএনপি বিরোধী দলে থেকে যদি বিদেশি কানেকশন করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে সেটা পারবে না সেটা কি করে ভাবা যায়? এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে যে, রাজনীতির কৌশল নির্ধারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে তুলনীয় আমাদের দেশে আর কেউ নেই। আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক রাজনীতি বিশ্লেষক কতগুলো আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতির এমন কাল্পনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করান যা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়েও আমাদের অনেকের অবস্থান অনেকটাই ‘কল্পলোকে’। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সত্তর বছর ধরে নীরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত আছে।

কিন্তু তাই বলে কি ভারতের নির্বাচনে কোনো অনিয়ম-জবরদস্তি হয় না? দখল, ছাপ্পা ভোট সেখানেও আছে। আমাদের দেশে বিএনপির মতো দল, যারা হত্যা-খুনেও আছে, নির্বাচনেও আছে, থাকবে, যতদিন তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও কৌশলে পরিবর্তন না আসবে ততদিন শতভাগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে না, ‘আমাদের দল আমরা যেভাবে খুশি সেভাবে চালাবো’ নীতি চলবে আর সরকারের কাছে কেবল নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রত্যাশা করলে হতাশ না হয়ে উপায় থাকবে না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমি প্রত্যাশা করব, অনুরোধ করব এবং দাবি করব, প্রার্থী এবং তার সমর্থক নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি মেনে চলবেন। প্রত্যেক ভোটার অবাধে এবং স্বাধীন বিবেকে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন’। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে, প্রার্থী ও সমর্থকরা যদি বেপরোয়া হয়ে না ওঠেন তাহলেই তো সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন এই বলে যে, ‘ভোটার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রার্থীর সমর্থক ও এজেন্ট যেন বিনা কারণে হয়রানির শিকার না হন বা মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন না হন, তার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ থাকবে। দল ও মত নির্বিশেষে সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ধর্ম, জাত, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদে সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। ভোট শেষে নিজ নিজ বাসস্থানে নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন’।

এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু সব পক্ষের উচিত হবে, সরকারের সঙ্গে পাঞ্জা না লড়ে নির্বাচন কমিশনকে তাদের অঙ্গীকার পালনে বাধ্য রাখা। সরকার নয়, নির্বাচন পরিচালনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন যদি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে, তাদের ওপর সংবিধান যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে সেটা পালনের সক্ষমতা দেখাতে পারে তাহলে মানুষের মন থেকে অনেক সংশয় দূর হবে। দেশে নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্ক তৈরি হয়।

গত কয়েকটি নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে নিয়ম করে। ভোট দিলেও মার খেতে হয়, না দিলেও মারের হাত থেকে রেহাই নেই। সংখ্যালঘুদের মনে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা সেটা দূর করতে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোটের আগে-পরে সংখ্যালঘুরা নিজ বাসাবাড়িতে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

একদিকে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচনের দাবি করা হবে, অন্যদিকে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে অনিশ্চিত করে তোলা হবে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অনেকেই সংখ্যালঘুদের এই বিশেষ সমস্যার কথাটি এড়িয়ে যেতে চান।

এবার দেশে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার, ৪৮০ জন। এর মধ্য পুরুষ ৫ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩২৯ জন। নারী ৫ কোটি ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৫১ জন। দেশের জনসংখ্যার যদি দশ শতাংশও সংখ্যালঘু হয় তাহলে ভোটার হওয়ার কথা কমবেশি এক কোটি।

এই এক কোটি ভোটারের ভোটদান প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করতে পারলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন করার পথ প্রশস্ত হবে। আমরা আশা করব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে না। সবার অংশগ্রহণে আমরা এমন একটি নির্বাচন চাই যে নির্বাচন কোনো নাগরিকের জীবন অনিরাপদ করে তুলবে না।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App