×

মুক্তচিন্তা

নিউইয়র্কে নির্বাচন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৬ পিএম

আমাদের দেশেও নির্বাচন আসছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো না, ঠিক কি কারণ জানা নেই শুধু মনে হয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কীভাবে একটা লাশ ফেলে দেয়া যায় সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে আমি এক চক্ষু হরিণের মতো, আমি জটিল রাজনীতিকে খুব সহজ করে বুঝতে চাই। যেহেতু এই দেশটি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে তাই এই দেশের সব রাজনীতি হতে হবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক।

আমার ধারণা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক জায়গা হচ্ছে এয়ারপোর্ট। যারা এয়ারপোর্টে কাজ করে নিশ্চয়ই তাদের কানের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা বলা হয়, ‘পৃথিবীতে কোনো ভালো মানুষ নেই। সবাই হচ্ছে খুনি ডাকাত বদমাইশ সন্ত্রাসী। তাদের কোনো কিছুকে বিশ্বাস করবে না।’ তাই যখন সিকিউরিটির জন্য দাঁড়ানো হয় তখন শরীরে যা কিছু আছে সবকিছু খুলে আলাদা করে ফেলতে হয়। বেল্ট, ঘড়ি, জুতো, জ্যাকেট, মোবাইল টেলিফোন, চাবির রিং, খুচরা পয়সা, ল্যাপটপ, মানিব্যাগ কিছুই সঙ্গে রাখা যাবে না। সেগুলো বাস্কেটে করে এক্স-রে করতে পাঠানো হয়।

কিছু কিছু ভয়ঙ্কর জিনিস আছে যেগুলো দেখলে সিকিউরিটির মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, তার একটা হচ্ছে পানি! সিকিউরিটিতে কাজ করতে করতে মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই অমানুুষ হয়ে যায়। এবারে আমি সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি, কারণ এবারে আমি যখন এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তখন আমাদের সঙ্গে একটি ছয় মাসের শিশু ছিল। তাকে আলাদা করে রাখতে হলো এবং ডাকাতের মতো একজন মানুষ তাকে টিপে-টুপে দেখলো সে গোপনে কোনো অস্ত্র নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে কিনা।

শুধু তাই না টিপে-টুপেই তারা নিঃসন্দেহ হলো না, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তাকে আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখল আসলে শিশুটি বড় কোনো সন্ত্রাসী কিনা! যে চাকরিতে ছয় মাসের অবোধ শিশুকে সন্দেহ করতে হয় সেই চাকরি না করলে কী হয়?

তবে পৃথিবীর দুটি এয়ারপোর্টে আমি এখনো যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করি, তার একটি হচ্ছে ঢাকা এয়ারপোর্ট। এখানে সবাই আমাকে চিনেন এবং ‘স্যার এখানে চলে আসেন’ বলে ডেকে নিজ থেকে সবকিছু করে দেন।

শুধু তাই না, পাসপোর্টে সিল দেয়ার সময় অনেকেই তাদের ছেলেমেয়ের গল্প করেন, আমার লেখালেখি পড়তে তারা ভালোবাসে সেই কথাটি জানিয়ে দেন।

দ্বিতীয় যে এয়ারপোর্টে আমি যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করি সেটি হচ্ছে নিউইয়র্কের এয়ারপোর্ট। এখানেও বাঙালি পুলিশ অফিসার ইমিগ্রেশনের লাইনে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাও আমাকে চিনে ফেলেন এবং আলাদাভাবে সাহায্য করেন। কাজ শেষ হওয়ার পর তারা আমার সঙ্গে একটা সেলফিও তুলে ফেলেন। আমাদের সঙ্গে যেহেতু একটা ছোট শিশু ছিল তাই এয়ারপোর্টের অপরিচিত মানুষরাও নিজ থেকে এগিয়ে এসে আমাদের সাহায্য করেন। যেখানে মানুষজন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আমাদের কখনো লাইনে দাঁড়াতে হয় না। ছোট শিশুকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হিসেবে না দেখে ছোট শিশু হিসেবেই দেখার মাঝে নিশ্চয়ই এক ধরনের আনন্দ আছে, অন্য এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির মানুষরা কখনোই সেই আনন্দটি উপভোগ করতে পারে না।

নিউইয়র্ক শহরটি নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ শহর। যারা এই শহরটিতে থেকেছেন কিংবা ঘুরতে এসেছেন সবাই এটি স্বীকার করবেন। একেকজন মানুষের কাছে শহরটিকে একেকটি কারণে চমকপ্রদ মনে হতে পারে। যেমন আমার কাছে এই শহরটিকে চমকপ্রদ মনে হওয়ার অনেক কারণের একটি কারণ হচ্ছে এখানকার মানুষের শরীরের উল্কি (Tattoo)! শীতকালে জাব্বা-জোব্বা পরে শরীর ঢেকে রাখতে হয় বলে বেশির ভাগ সময় উল্কি দেখা যায় না। গ্রীষ্মে বা গরমের সময় এখানকার মানুষের উল্কি উপভোগ করা যায়। শৈশবে শুধু এক রংয়ের উল্কি দেখেছি, কিন্তু উল্কি যে কত বিচিত্র রংয়ের হতে পারে এবং কত নান্দনিক হতে পারে সেটি এখানে না এলে কেউ অনুমান করতে পারবে না।

তবে যে কারণে নিউইয়র্ক শহর সম্ভবত সারা পৃথিবীর সব শহর থেকে আলাদা করা যায় সেটি হচ্ছে এখানকার মানুষের বৈচিত্র্যে (Diversity। শহরটি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি শুধু তাদের মুখের কথা শোনার চেষ্টা করা হয় তাহলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করা যায় কত বিচিত্র এখানকার মানুষের মুখের ভাষা! আমি মিনিট দশেক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মানুষজনকে যেতে দেখেছি এর মাঝে দুজন বাঙালি মহিলাকে খাঁটি সিলেটি ভাষায় কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে দেখলাম!

আমার ধারণা যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় যদি মানুষদের লক্ষ্য করা যায় বেশিরভাগ সময় দেখা যাবে তারা ইংরেজি নয় পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় কথা বলছে!

আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকশন হচ্ছে। আমাদের দেশে ইলেকশন বিশাল একটি ঘটনা। দেশে এখনো প্রার্থীদের নমিনেশন দেয়া হয়নি কিন্তু মনে হয় পুরো দেশ মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পোস্টারে ঢেকে গেছে। ইলেকশনের দিন দেশের মানুষ সেজেগুজে ভোট দিতে আসে। কত মানুষ ভোট দিয়েছে জানার জন্য ইন্টারনেটে খোঁজ করেছিলাম, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় আশি শতাংশ ভোটার ভোট দেয়। আমেরিকায় সেই সংখ্যাটি মাত্র পঞ্চান্ন শতাংশ। কাজেই এই দেশের মানুষকে ভোট দেয়ানোর জন্য অনেক চেষ্টাচরিত করা হয়। খুব যে লাভ হয় তা মনে হয় না।

আমি একজন ভোটারের সঙ্গে ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। মানুষজনকে ভোট দিতে উৎসাহী করার জন্য পুরো ব্যাপারটি খুবই সহজ করে রাখা হয়েছে। গিয়ে নিজের নাম বললেই তাকে একটা ব্যালট পেপার দেয়া হচ্ছে। ভোট দেয়ার নিয়ম-কানুন কমপক্ষে দশটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লেখা আছে তার মাঝে বাংলাও আছে! পাশাপাশি অনেক ডেস্ক মানুষজন আলাপ-আলোচনা করে ব্যালটে টিক চিহ্ন দিচ্ছে! টিক চিহ্ন দেয়ার পর স্ক্যানারে স্ক্যান করে ভোটার ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসছে। মানুষজন যেহেতু ভোট দেয় না তাই যারা কষ্ট করে ভোট দিতে আসে তাদের একটা স্টিকার দেয়া হয়। সেখানে লেখা ‘আমি ভোট দিয়েছি’ সেটা বুকে লাগিয়ে গর্বিত ভোটার ঘুরে বেড়ায়।

তবে যারা এই দেশে স্থায়ীভাবে থাকে তারা আমাকে বারবার সতর্ক করে বলেছে আমি যেন নিউইয়র্ককে দেখে সারা আমেরিকা সম্পর্কে একটা ধারণা করার চেষ্টা না করি। নিউইয়র্ক শহরটি পুরোপুরি অন্য রকম, এখানে পুলিশ কোনো মানুষকে ধরে কখনোই জানতে চাইতে পারবে না তার কী কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা! এই দেশের অনেক জায়গা আছে যেখানে কালো বা দরিদ্র মানুষরা যেন ভোট দেয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে সেই জন্য পুরো প্রক্রিয়াটাকে কঠিন করে রাখা আছে। ভোটার তালিকায় নাম খুঁজে পাওয়া যায় না, প্রতি বছর ভোট কেন্দ্র পাল্টানো হয়, নানা রকম আইডি দেখিয়ে ব্যালট নিতে হয়, লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এবং কিছুদিনের ভেতরেই দরিদ্র মানুষ ভোট দেয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত গণতন্ত্রের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। এই দেশে এক ধরনের গণতন্ত্র নিশ্চয়ই আছে তা না হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একটি উৎকট রসিক কেমন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারে? আমার ধারণা ছিল এবারকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দলটিকে এই দেশের মানুষ বিদায় করে ফেলে। সেটা হয়নি, কংগ্রেসের এক পক্ষ এখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের দখলে। নিচের কাজটি তার হাতছাড়া হয়েছে, এবারে আমি আগ্রহ নিয়ে দেখার চেষ্টা করব একজন প্রবলভাবে মিথ্যাচারী, হিংসুটে, প্রতিহিংসাপরায়ণ, পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণাপরায়ণ প্রেসিডেন্টকে একটুখানি হলেও আটকে রাখা যায় কি না। যদি সে রকম কিছু ঘটে তাহলে এই দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটুখাানি হলেও বিশ্বাস ফিরে আসবে।

আমাদের দেশেও নির্বাচন আসছে। দেশের বাইরে থেকে ইন্টারনেটে দেশের সব খবর পেয়ে গেলেও দেশটিকে অনুভব করা যায় না। নির্বাচন নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো না, ঠিক কি কারণ জানা নেই শুধু মনে হয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কীভাবে একটা লাশ ফেলে দেয়া যায় সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

তবে আমি এক চক্ষু হরিণের মতো, আমি জটিল রাজনীতিকে খুব সহজ করে বুঝতে চাই। যেহেতু এই দেশটি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে তাই এই দেশের সব রাজনীতি হতে হবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো সেটি মুখে স্পষ্ট করে উচ্চারণ না করবে আমি সেই রাজনৈতিক দলটিকে বিশ্বাস করতে পারি না। বিএনপি এখনো মুখে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেনি তারা নির্বাচন করবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়া যে কারণে বিকল্প ধারা তাদের সঙ্গে ফ্রন্ট করেনি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ইন্ডিয়ান নেতা ড. কামাল হোসেনের কাছে বিষয়টি সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগ্রহী নন। সম্ভবত এটাকেই রাজনীতি বলে। আমি সেই রাজনীতি চোখ দিয়ে দেখব কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App