×

মুক্তচিন্তা

জাতি নির্বাচনের দিকে হাঁটছে

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২৪ পিএম

সাত দফার মধ্যে তিন-সাড়ে তিন দফা মানলেও ভালো। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। সংলাপ ব্যর্থ হলো, ভালো হলো না- এমন অনেক কথাই বলা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কিংবা বারবার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির মতো ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি এবং সবাই মিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব- এটাই শেষ কথা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চলছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা মহল সংলাপের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছিল। গণতন্ত্রের সেই কাক্সিক্ষত সংলাপ এখন অব্যাহত। তবে চলমান এ সংলাপের ফলাফল নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন। সংলাপের মাধ্যমে আদৌ কোনো বিরোধের মীমাংসা হবে কিনা? তবে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, সংলাপের ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কিছু নেই। সংলাপ নিজেই একটি অর্জন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে আসছিলাম। আমাদের রাজনীতিতে বিবদমান বিরোধগুলো নিষ্পত্তির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একসঙ্গে বসে আলোচনা অর্থাৎ সংলাপ হওয়া দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারের সংলাপই প্রথম সংলাপ, যা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যদিও এর আগে রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির মধ্যে সংলাপ আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে সংলাপ এবারই প্রথম। বর্তমানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বড় বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এই দলের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের সংলাপ হচ্ছে আমার জানা মতে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়ের প্রথম। এই সংলাপ অবশ্যই রাজনীতির মাঠে এক নতুন আশাবাদের সঞ্চার করেছে। সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন বললেন, এক মিনিটে সংকট সমাধানের পথ দেখাবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এক মিনিটে সমাধানের পথ দেখানো এত সহজ নয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফাই হচ্ছে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি। কিন্তু আমি মনে করি না যে, রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কিছু একটা করতে পারবে। কারণ আনুষ্ঠানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কতকগুলো পর্যায় অতিক্রম করে জিয়ার কারাদণ্ড হয়েছে। বিচারিক কার্যক্রম নিম্ন আদালত হয়ে হাইকোর্টের রায়ে হয়েছে। কাজেই মামলাটি এখনো একটি বিচারিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি বিচার না মানে, আইন না মানে কিংবা তারা যেসব বক্তব্য প্রদান করছে, এই রায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ, ফরমায়েশি রায়, এটা সেটা ইত্যাদি যা তারা বলে থাকে। ওই বিষয়গুলো ভিন্ন কথা। কিন্তু দিন শেষে আমাদের আইনের শাসন মানতেই হবে। ড. কামাল হোসেন আজীবন আইনের শাসন, সুশাসন এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ- এমন অনেক কথাই বলে আসছেন। সেখানে তিনি কীভাবে আইন অমান্য করে এক মিনিটের মধ্যে সমাধান দিবেন? কি এমন সমাধান, সেটি ড. কামাল হোসেনকে বলতে হবে। সংবিধানের বাইরে কিংবা ভেতরে কীভাবে এই সমস্যার পথ দেখাবেন আমার জানা নেই। আইনি পথ ছাড়া আর কোনো উপায় আছে বলে আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলেই একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ছেড়ে দিতে পারবেন না। কেননা সর্বোচ্চ আদালত তাকে শাস্তি দিয়েছে। কাজেই বিষয়টি এখন আদালতের এখতিয়ার। তবে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বিষয়টি যখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। তখন বিষয়টি দেখা যেতে পারে। ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে কিছু একটা হতে পারে। কিন্তু এর আগে মুক্তির কোনো সুযোগ আপাতত নেই। তাদের আরেকটি দাবি হলো সরকারের পদত্যাগ। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করার আর কোনো সময় নেই। আগামী সাত-আট দিনের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবে। পুরো জাতি নির্বাচনের জন্য তৈরি হচ্ছে। যে যত কথা ঢাকায় বলুক না কেন, গ্রামেগঞ্জে সব জায়গায় বিএনপিসহ সমগ্র জাতি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের জাতীয় সংসদ ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। শেষ অধিবেশন হয়েছে। এই সংসদ বসার আর সুযোগ নেই, বসতেও পারবে না। সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে ডিসমিস, ডিজমেন্ট শব্দগুলো ব্যবহার হয় না। ডিজল্ভ্ (উরংংড়ষাব) শব্দটি ব্যবহার হয়। ওয়েবস্টার কিংবা অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ডিজল্ভ্ শব্দের অর্থ হচ্ছে দ্রবীভূত হওয়া। অর্থাৎ পানির মধ্যে চিনি দিলে চিনি দ্রবণ হয়ে যাবে। চিনি গলে যায়। আবার ইচ্ছা করলে পানি থেকে চিনি উদ্ধার করা সম্ভব। তাপ দিয়ে পানি শুকালে ফের চিনিই পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে কেন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে? পৃথিবীর কোনো দেশে সংসদ একেবারে ভেঙে দেয়া হয় না। বরং সংসদ ডিজল্ভ্ করা হয়। দেশের জরুরি জাতীয় প্রয়োজনে আবার সংসদ রিভাইভ করতে পারবে। এসব বিষয় আমাদের জাতীয় সংবিধানে ছিল। ড. কামাল হোসেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এই সব কাজ করেছেন। কাজেই বর্তমান সংসদ অকার্যকর সংসদ। কিন্তু প্রয়োজন হলে ফের কার্যকর হবে। অকার্যকর সংসদে সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষমতা, দাপট, কোনো পদ পদবি কিছুই থাকবে না। বিষয়টি এমন যে, এটি জীবিত আর মৃত অবস্থার মাঝখানে। দীর্ঘদিন রোগী ‘কোমায়’ থাকার মতো অবস্থা। কাজেই এই সংসদকে আর ভেঙে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর ভাঙবেই বা কী? সংসদ তো ইতোমধ্যে মৃত! নির্বাচনে সংঘাতের মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই ঘটনা ইতিহাসে বারবার একইভাবে ঘটে না। সংলাপে অনেক দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সংলাপের আলোচনা যদি নির্বাচনকালীন সরকার দিয়ে শুরু হয়, তাহলে কিছু করার নেই। কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংলাপে বরং তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি পরে আসা উচিত। আর বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করারও আর সময় নেই। গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই সুন্দরভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। সর্বশেষ ২০০১ সালে করেছে। এবারো একইভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। সরকার কোনোভাবে পদত্যাগ করবে না। বিএনপি সোয়া দুইবার ক্ষমতায় ছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নিয়ে সোয়া দুইবার। দুইবারই বেশ অপমানের সঙ্গে তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। কারণ ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে রাতের বেলায় পালিয়ে চলে যেতে হয়েছে। ২০০৭ সালে সেই ওয়ান-ইলেভেনের সময় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনদের ধাক্কা খেয়ে চলে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি কোনো সময় শাস্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির রেখে যাচ্ছে। কাজেই সরকারের কোনোভাবে পদত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। সংলাপের মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর রাখার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সংলাপের শুরুই করতে হবে ছোট ছোট বিষয় দিয়ে। যেমন- নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সমস্যার সমাধান এক মিনিটের মধ্যে করা যায়। পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম কোথাও ব্যবহার হবে, নতুবা হবে না। এর মধ্য দিয়ে ইভিএম আলোচনা শেষ হবে। আরেকটি বিষয় হলো নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন। অতীতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এবারো স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। কিন্তু সেনাবাহিনীকে কোনো বিচারিক ক্ষমতা দেয়া যাবে না। যা অতীতে কখনো দেয়া হয়নি। কারণ একমাত্র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া আর কারো হাতে জুডিসিয়াল ক্ষমতা দেয়ার এখতিয়ার নেই। আরেকটি বিষয় সবাইকে সভা, সমাবেশ, মিটিং মিছিল করার অধিকার অবাধে দিতে হবে। ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া নতুন করে আর কাউকে মামলায় জড়ানো হবে না। সংলাপে এ বিষয়গুলো আগে মীমাংসা করতে হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার মধ্যে এগুলোই রয়েছে। ২০১৪ সালে প্রস্তাব দিয়েছিল সংবিধানের মধ্য থেকে কয়েকজনকে মন্ত্রী বানানো। সেটা হতে পারে। ঐক্যফ্রন্ট থেকে মন্ত্রী চাওয়া হলে সেভাবে হতে পারে। কিন্তু সেই মান্নান ভূঁইয়া কিংবা জলিল ভাইয়ের আমল থেকে যেভাবে চাওয়া হচ্ছে, একই দাবি ‘নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার। এখন মানুষের কাছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বের করা হয়েছিল। পরে তাকেও ব্যাপক পচানো হলো। কাজেই এখন এ রকম আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব না। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, এর আগে আমরা সংবিধানবহিভর্‚তভাবে অনেক কিছুই করেছি। কিন্তু সেই সুযোগ আর নেই। সে সময় কেবল সংবিধান ছিল। কিন্তু এখন সর্বোচ্চ আদালত এফিলেড ডিভিশনের রায় রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে এই প্রজাতন্ত্র এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত কারো দ্বারা শাসিত হতে পারবে না। এখন যে ব্যবস্থাই করা হোক না কেন, কেউ একজন আদালতে মামলা করলেই আটকে যাবে। কাজেই আর কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন ‘সংবিধানসম্মতভাবে’ যা কিছু করা যায়। সে দিক লক্ষ রেখে ড. কামাল হোসেনকে সংবিধানসম্মতভাবে আলোচনা করতে হবে এবং পথ খুঁজতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। জামায়াত-শিবিরের হামলা সংঘর্ষের মামলা। কিংবা আ স ম আব্দুর রবের এক সময়ের কারাদণ্ড। এগুলো ভিন্ন বিষয়। কিন্তু অন্যান্য মামলার সঙ্গে খালেদা জিয়ার মামলার নেচার এক নয়। ব্রিটিশ আমল থেকে রাজনৈতিক হত্যা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, মারামারি, হামলা সংঘর্ষের ঘটনার মামলার নেচার আর খালেদা জিয়ার মামলার নেচার একরকম নয়। এটি হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ আত্মসাতের দুর্নীতির মামলা। অন্য মামলার সঙ্গে এই মামলার মিল খোঁজার কোনো সুযোগ নেই। আদালতের মাধ্যমে মামলার মীমাংসা হতে হবে। তবে সংলাপে শতভাগ দাবি পূরণ হবে- এমন আশা করা যায় না। আর কোনোদিনই তা হবে না। সাত দফার মধ্যে তিন সাড়ে তিন দফা মানলেও ভালো। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। সংলাপ ব্যর্থ হলো, ভালো হলো না- এমন অনেক কথাই বলা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কিংবা বারবার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির মতো ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি এবং সবাই মিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব- এটাই শেষ কথা। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App