×

মুক্তচিন্তা

ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি সংস্কৃতির সংগ্রাম?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৭ পিএম

‘আমিই শেষ কথা নয়!’ কথাটা সব সময় আমাদের মনে থাকে না। যখন বিষয়টি একান্তই আমার, তখন না হলেও, বিষয়টি যখন ‘আমাদের’, তখন কথাটা মনে রাখা জরুরি। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কোনো কোনো আঙিনার মানুষের এ কথাটা মনে না থাকলেও নাট্যাঙ্গনের মানুষের কথাটা মনে থাকাই সঙ্গত; কারণ নাটক যৌথ শিল্পকলা। একটি নাটককে চূড়ান্ত পূর্ণতা দিতে একদল মানুষের অংশগ্রহণ এবং আত্মনিবেদনের প্রয়োজন পড়ে। ভিন্নমত-পথ ও চিন্তার সমন্বয় ঘটাতে পারলেই নাটক পূর্ণতা পায়। আমাদের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী মহোদয় নিজে নাট্যজন এবং স্বনামখ্যাত বাচিকশিল্পী, তার কাছে ভিন্নমত-পথ ও চিন্তার মানুষের বিবেচনা মূল্য পাবে, এমন প্রত্যাশা মানুষ করতেই পারে; তার কথা ও কাজে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। দেশে যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা-কূপম-ূকতা যখন সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃতি পায়, ধর্মের নামে যখন সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলে, তখন সেসব অপশক্তিকে রুখতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এ সত্যটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতির সংগ্রামকে গতিশীল এবং সদর্থক করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমাদের যথেষ্টই দূরদর্শী এবং সম্পন্ন চিন্তার অধিকারী হতে হবে, কিন্তু সে কথাটি তাদের মনে থাকে কিনা কখনো কখনো তা নিয়ে সন্দেহ জাগে, অথচ কথাটির গুরুত্ব কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না; এ দাবি সমাজ সচেতন প্রতিটি প্রাগ্রসর মানুষের প্রাণের দাবি।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে সম্প্রতি বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় ভাটিয়ালি সঙ্গীত উৎসব-২০১৮’ উত্তর পর্যালোচনায় আমার আজকের নিবেদন। ২৪, ২৫ ও ২৬ অক্টোবর তিন দিনের এ উৎসবে ভাটিয়ালি সঙ্গীত এবং ভাটি অঞ্চলের মানুষের যথেষ্ট অংশগ্রহণ না থাকলেও এটি প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত নির্বিঘেœ চলেছে, উৎসবে নগর-মানুষের যথেষ্ট এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও ছিল। উৎসবোত্তর সময়ে কিছু কিছু বিচ্যুতি এবং সমালোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’ সরব দেখেছি। ফেসবুকের সমালোচনাকে সব সময়ই আমি বস্তুনিষ্ঠ মনে করি না, এ কথা যেমন সত্য তেমনি ফেসবুকের সব বন্ধুর সব বক্তব্যকেই সর্বাংশে দুষ্টলোকের অপপ্রচার বলে উড়িয়েও দিতে পারছি না। আয়োজন সংশ্লিষ্ট অনেকেরই, নিজের তো নয়ই, নিকট-পূর্বপ্রজন্মের কারো সঙ্গীত সংশ্লিষ্টতার বার্তা আমাদের কাছে নেই, এ অভিযোগ তো মিথ্যা নয়, হয়তো একই কারণে উৎসবের আমন্ত্রণ তালিকা থেকে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পীদের নাম বাদ পড়ে গেছে, আমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়ে গেছেন সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই- যা দুঃখজনক এবং অনাকাক্সিক্ষতও বটে। আর্থিক অনাচারের বিষয়টিকে অপপ্রচার ভেবে আলোচনায় নাইবা আনলাম। কিন্তু এ কথা অবশ্যই বলতে চাই, যেখানে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ নিতান্তই কম, সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হওয়াটা সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে কাক্সিক্ষত।

আমি বিশ্বাস করি স্বয়ং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীরও তাই। জাতীয় ভাটিয়ালি উৎসবের আমন্ত্রণপত্র এবং উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকাটি হাতে নিলেই ময়মনসিংহের যে কোনো সচেতন মানুষ জেনে যান উৎসবটি কোন বলয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। শুনেছি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যাশা ছিল ‘উৎসবটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।’ যা ভিন্নমত-পথ ও চিন্তার মানুষকে সমন্বয় চিন্তার কথাই মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ মানে কী? বাস্তবচিত্র দেখে মনে হয়েছে উৎসবে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের শরিক দলগুলোকে পরিহার করা হয়েছে বরং সরকারবিরোধী শিবিরের একটি বিশেষ দলের প্রভাববলয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে উৎসব। উৎসব উদযাপন কমিটি আর উপকমিটিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে। যাক সেসব দলীয় বিষয়ে সমালোচনা আমার রচনার উদ্দেশ্য নয়, এ সব বিষয় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা বুঝবেন, আমার বক্তব্য ভিন্ন জায়গায়। উৎসবে বেশ কিছু ব্যয়বহুল পরিবেশনা ছিল, যার সঙ্গে ভাটিয়ালি গানের ন্যূনতম যোগসূত্র নেই, ধরা যাক ‘মহুয়া’ গীতিনৃত্যনাট্যের কথা; মহুয়া আমাদের লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ সন্দেহ নেই, নাগরিকরা এটি যথেষ্ট উপভোগও করবেন, কিন্তু মহুয়ার সঙ্গে ভাটিয়ালি গানের কোথায় সংযোগ বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না ‘জয়তুন বিবির পালা’র সঙ্গেইবা ভাটিয়ালি গানের সংযোগ কোথায়? বাংলা লোকসঙ্গীতের ধারায় ‘ভাটিয়ালি’ এক উল্লেখযোগ্য গীত-মাধ্যম। ভাটিয়ালির পাশাপাশি জারি, সারি, মুর্শিদি, বাউল, বিচ্ছেদি, বারোমাসি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, কবিগান, পালাগান, পল্লীগান, সাপুড়ে গান, গাইনের গীত, হাইট্টারা গীত, বিয়ের গীত, কীর্তন, ধামাইল, ঘাটুগান ইত্যাদিসহ নানান আঙ্গিকের গীত-রীতি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে এবং যা কালের বিবর্তনে কিছুটা অপসৃয়মাণও বটে। এ ধরনের উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে লোকবাংলার অপসৃয়মাণ বিভিন্ন আঙ্গিকের গান সমকালীন মানুষের সামনে তুলে আনা যেতেই পারে এবং এ ধরনের জাতীয় উৎসব সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করি। কিন্তু কোনো উৎসবই সংশ্লিষ্ট আঙিনার শিল্পীদের উপেক্ষা করে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সবচেয়ে বড় কথা লোকসঙ্গীত কোনো নাগরিক কারখানায় নির্মিত হওয়ার বিষয় নয়। তা ছাড়া কোনো উৎসবকে যখন ‘জাতীয় উৎসব’ বলে ঘোষণা করা হবে তখন উৎসবের মান জাতীয় পর্যায়েরই হওয়া উচিত, তা না হলে কেবল সংশ্লিষ্ট জনপদ নয় বরং ‘জাতীয় মান’ নিয়েও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়।

উৎসবের স্মরণিকায় প্রকাশিত রচনা পাঠে জাতীয় উৎসবের ‘জাতীয় মান’ সংরক্ষিত হয়েছে বলতে পারি না কিছুতেই, ভাটিয়ালি আর সারিগানের ফারাক স¤পর্কে আয়োজকদের সম্যক ধারণা আছে সেটিও মনে হয়নি কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সেমিনার, প্রাবন্ধিক, আলোচক সব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে, আমি সে সবও বলতে চাই না, আমার বক্তব্য ‘জাতীয় ভাটিয়ালি উৎসব’-এর মতো একটা উৎসব আয়োজন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যে গুরুদায়িত্ব পালন করল, আমরা হয়তো তার সদ্ব্যবহার করতে পারলাম না। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সিলেট বিভাগের কিছু অংশের সমন্বয়ে যে সাংস্কৃতিক অঞ্চল, সে অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি অথবা লোকসঙ্গীতের যে ঋদ্ধি তার খবর কেবল জাতীয়ভাবে নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। এ অঞ্চলের লোকসঙ্গীত এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গান নিয়ে যদি জাতীয় লোকসঙ্গীত উৎসব আয়োজন করা হতো, তাহলে সেটা হতো অনেক বেশি বর্ণাঢ্য এবং হৃদয়গ্রাহী। মানুষ অনেক বেশি বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়ার পাশাপাশি বাঙালিয়ানায় নিজেদের উজ্জীবিত করে নিতে পারতেন। অনেক বেশি শিল্পী-কুশলীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত। অবশ্য আয়োজন যাই করা হোক আয়োজকদের নিজেদের প্রজ্ঞা-জ্ঞান-মেধার সমন্বয় করা গেলেই সেটা সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠতে পারত, সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তারপরও যারা এ উৎসব আয়োজনের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন তাদের আমি অভিনন্দন জানানোর পরও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের আয়োজন থেকে বাইরে রেখে কখনোই উত্তীর্ণ কিছু পাওয়া সম্ভব নয়, সে সত্যটাও সবার মনে রাখা আবশ্যক। উৎসবোত্তর পর্যালোচনায় আমরা যদি নিজেদের ঊনতাগুলোকে চিহ্নিত করে ঔদার্য নিয়ে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি, আমরা যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে মনে রেখে সাংস্কৃতিক পরম্পরা রক্ষার স্বার্থে নিজেদের ক্ষুদ্রতাগুলোকে পরিহার করতে পারি, তাহলেই সংস্কৃতির সংগ্রাম দিয়ে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা-কূপম-ূকতাকে, ধর্মের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিরোধ করতে পারব, আমাদের মুক্তির চেতনাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলা করতে পারব আর যদি ‘আমিই শেষ কথা নয়’! এ কথায় আমাদের আস্থা না থাকে, তাহলে সে সব অপশক্তি বারবার আমাদের মুক্তির পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলবে।

আমাদের ১৯৭৫-এর দুর্বিষহ স্মৃতির কথা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা জাতির বিভিন্ন সংকটে ১৯৭১-এর চেতনাকে বুকে নিয়ে প্রগতির সংগ্রামে যেভাবে নিজেদের নিবেদন করেছেন, সে পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখবেন তারা নিজেরাই, সে আমার বিশ্বাস। নিজেদের মধ্য অন্তর্দ্বন্দ্ব-আত্মকলহে আমরা যেন পরস্পরের নাম মুছে ফেলতে উদ্যোগী না হই, তাহলে সে অপরিণামদর্শিতার ফল হবে জাতির জন্য ভয়াবহ। বাঙালি জাতির ‘মহানায়ক’ বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার ২১ বছরের ষড়যন্ত্রে জাতি হিসেবে আমরা কতটা পিছিয়ে গেছি সে সত্যটি আমরা যেন বিস্মৃত না হই।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App