×

মুক্তচিন্তা

জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষাও যখন কম গুরুত্ব পায়!

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৩ পিএম

আমাদের দেশের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি উদাসীন মনোভাব সহ্য করা কঠিন। আর পাবলিক পরীক্ষার প্রায়োরিটি কেনই বা শোকরানা মাহফিল থেকে কম হবে! আর কওমি মাদ্রাসাকে সনদ স্বীকৃতি দেয়ার আয়োজন তো অন্যদিনেও করা যেত, যেত না? মনটা কেন ভীত হচ্ছে এই ভেবে যে, এ দেশ আসলে কোন শিক্ষায় পরিচালিত হতে চলেছে কিংবা পরিচালিত হবে আগামীতে। জানি না। যারা দেশ নিয়ে বেশি ভাবেন, যারা দেশকে বেশি ভালোবাসেন বলে দাবি করেন, তারাই জানেন। তারাই জানুক।

৩ নভেম্বর শনিবার। ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে হৈচৈ শুরু হলো জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার্থীদের বাড়িতে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবকদের মোবাইলে স্কুল থেকে মেসেজ পাঠানো হলো, ৪ নভেম্বরের নির্ধারিত পরীক্ষা অনিবার্যবশত স্থগিত করা হয়েছে। এই পরীক্ষা হবে ৯ নভেম্বর। কারণ উল্লেখ নেই। শুধু অনিবার্যবশত বলা হয়েছে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে মিডিয়ার দিকে চোখ, কান মেলে থাকলেন। কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। সংবাদ পাঠক-পাঠিকার কণ্ঠ থেকে তো নয়ই, স্ক্রলেও ভেসে যায় না পেছানোর কারণ। উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা এদিক-ওদিক ফোন করে একে অপরের কাছে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হন। সঠিক উত্তর মেলে না। অবশেষে যা হয় সঠিক কারণ না জানতে পারলে, তাই-ই হলো। গুজবের মতো কিছু কথাবার্তা, ধারণা ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিল, প্রায় লাগামহীন ছোটাছুটি এবং তা মুখে মুখে, ফোনে ফোনে। কিন্তু কেউ তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে বা প্রকাশ করতে সাহস করেন না। পলিটিক্যাল পারসন ছাড়া তো বুকের পাটা বেশি মানুষের নেই। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধরা খেলে নির্ঘাত খবর হবে। কে তারে ছুটিয়ে আনবে, এই চিন্তা-চেতনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ কিছু আর বলেন না। কিংবা যাওবা বলেন, তা খুবই সামান্য। চোখে পড়ার মতো নয়, অনেকটা এরিয়ে যাওয়ার মতো। ফলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কোনো কারণ উদ্ধার করা সম্ভব হলো না।

সে যাক। মূল কথায় আসি। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা হলো, স্কুল মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা। সবাই তা জানেন, মানেন। কিন্তু আজ প্রশ্ন জেগেছে, কী জানি? উত্তরটা দেয়ার কারোর প্রয়োজনবোধ দেখা যাচ্ছে না। ফলে উত্তরটা আপনা থেকেই জেগে উঠবে, প্রকৃতি দেবে উত্তর। অনেক শিক্ষক মনে করেন, এটা হলো মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পাস করার একটি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। শিক্ষার উপরের স্তরে ওঠার প্রথম ধাপ। অনেক কিছু শেখার আছে এই ধাপে। ঠিকমতো শেখা না হলে, উপরের ধাপে টিকে থাকা কষ্টকর হবে। অনেকে বলেন এটা ফাউন্ডেশন স্তর। পরীক্ষার্থীরা দিনরাত এক করে প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে। অভিভাবকরা থাকেন উদ্বিগ্ন। সন্তানের সঙ্গে তাদের থাকে দৌড়াদৌড়ি, ব্যতিব্যস্ততা। এটাই মানবজীবনের সহজাত প্রবৃত্তি, প্রত্যাশা। মা-বাবা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য। আর এই মানুষ হওয়ার অন্যতম জরুরি বিষয় হলো শিক্ষা। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। সেই বাবা-মা ততটাই থাকেন আশ্বস্ত, ততটাই হন সার্থক। এটা পরীক্ষিত, প্রমাণিত এবং দৃশ্যমান। এমন একটি পরীক্ষার তারিখ আচমকা, বিনা নোটিসে পেছানো হবে, তা যেন কল্পনাতীত। এখন তো আর হরতাল কেউ ডাকে না। অবরোধও হয় না। তাহলে? সাধারণ মানুষ কিন্তু অনেক কিছুই ভেবে বসেছেন, ভেবে নিয়েছেন। ভাবাটাই তো স্বাভাবিক। সাত-পাঁচ ভাবার সুযোগ করে দিলে তো মানুষ ভাববেনই। কে না ভাবেন? সাধারণ মানুষের কী দোষ। এই পরীক্ষার তারিখ পেছানো সম্পর্কে একজন পরিচিত অভিভাবক ধারণা করে বসলেন, নির্ঘাত প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পত্রিকায় নাকি কী একটা সংবাদ ছাপানো হয়েছে, যেখানে বিসিএস, সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরা হয়েছে। মনে হয় নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন সংবাদ কিংবা প্রমাণ আছে যে, জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁসকারী চক্রের হাতে আছে। সম্ভাবনা আছে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার। তাই সরকার তড়িঘড়ি করে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াকে রোধ করতেই পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্থগিত করেছেন, মানে পিছিয়ে দিয়েছেন। অভিভাবকের এমন ধারণা খারাপ নয়। বরং এমন উদ্যোগ গ্রহণে সরকার সাধুবাদ পেতেই পারেন। সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হতে পারেন, আস্থা রাখতে পারেন এই ভেবে যে, সরকার যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে, সচেতন হচ্ছে। ফলে আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, তেমন সুযোগ নেই। কিন্তু কোমলমতি পরীক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল এই ভেবে যে, ৮, ৯ ও ১০ তারিখ পরপর পরীক্ষা। কী করে পড়ে পরপর পরীক্ষা দেয়া সম্ভব! একটা পরীক্ষা দিয়ে এসে, বিশ্রাম নিয়ে কোনোমতে চোখ বুলিয়ে, পরের দিন আরেকটি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার মতো মস্তিষ্কের সক্ষমতা, শক্তি আদৌ কোমলমতি শিশুদের আছে কিনা, কেউ একবার ভেবেও দেখলেন না! এমন বেদনাহত প্রতিক্রিয়াও ছিল না কারোর কারোর চোখে-মুখে! এমন সব জল্পনা-কল্পনার মধ্যে কোমলমতি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মেনে নিলেন, ৪ নভেম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে ৯ নভেম্বর।

৩ নভেম্বর রাতে একজন ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন, আগামীকাল ৪ নভেম্বর কী? কী খুঁজে ফিরে দেখলাম, কী এর উত্তরটা আমারও জানা নেই। একটি টিভি চ্যানেলের একজন প্রিয় সাংবাদিককে প্রশ্ন করলাম, আগামীকাল কী? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী মানে? প্রশ্নেরও ভোগান্তি থাকে, যদি না তার পুরো রূপ চিত্রায়িত করা সম্ভব হয়। একটি প্রশ্ন, অনেক প্রশ্নের একমাত্র কারণ হতে পারে, যদি না প্রশ্নটি পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়। বললাম, কী যেন হবে শুনলাম, গাড়িঘোড়া চলবে না। তিনি অট্টহাসি দিয়ে বললেন, গাড়ি চলে শহরের রাস্তায় জানতাম, ঘোড়া তো নয়। তাকে সহায়তা করার জন্য বললাম, নিশ্চয়ই যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি আছে। সরকার সম্প্রতি সংলাপ অনুষ্ঠানে বলেছেন, সভা-সমাবেশ করা যাবে। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কাম্য সরকারের। অথচ সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিরোধী রাজনৈতিক দল বলেছেন, সরকার ৭ দফা মেনে নেয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। সুতরাং আন্দোলন চলবে। কাল কী তাদের সভা-সমাবেশ, আন্দোলন, গাড়িঘোড়া চলবে না? প্রিয় সাংবাদিক তুড়ি মারলেন। উড়ে গেল আমার ধারণা। জানলাম, সড়ক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে কয়েকটি সড়কের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কারণ দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমানের স্বীকৃতি দেয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে ৪ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ আয়োজিত শোকরানা মাহফিলে এই সংবর্ধনা দেয়া হবে। এই শোকরানা মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই জন্য রাস্তাঘাটে কিছু নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে। রাখতেই পারেন সরকার প্রধান যাতায়াত করবেন বিধায়। খুব জানতে ইচ্ছে করছে না বলে বলা ভালো যে, একটা বিস্ময়কর প্রশ্নের উত্তর চাইছি, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা কী এই শোকরানা মাহফিলের জন্যই পেছানো হয়েছে? যে অনিবার্য কারণ বলা হয়েছে পেছানোর জন্য, সেটাই বা কী? কেউ বলছেন, সামনে নির্বাচন। ভোটের রাজনীতিতে দেশ চলে। সুতরাং আলেমদের নিয়ে এই সভা জরুরি ছিল।

আজ জনমনে যে বিস্ময়, যে জিজ্ঞাসা, তার জবাব না পেলে ‘গুজব’ তৈরি হবে, তৈরি হওয়ার সুযোগ হবে। এই সুযোগ নিজেদের ঘরে নেবে স্বার্থান্বেষী মহল। এটা বুঝি তো? আর উত্তর যদি এটাই হয় যে, শোকরানা মাহফিলের জন্য পরীক্ষা পেছানো হয়েছে, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যে, এমন সিদ্ধান্ত জনগণকে মর্মাহত করার মতো হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত। আমাদের দেশের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি উদাসীন মনোভাব সহ্য করা কঠিন। আর পাবলিক পরীক্ষার প্রায়োরিটি কেনই বা শোকরানা মাহফিল থেকে কম হবে! আর কওমি মাদ্রাসাকে সনদ স্বীকৃতি দেয়ার আয়োজন তো অন্যদিনেও করা যেত, যেত না? মনটা কেন ভীত হচ্ছে এই ভেবে যে, এ দেশ আসলে কোন শিক্ষায় পরিচালিত হতে চলেছে কিংবা পরিচালিত হবে আগামীতে। জানি না। যারা দেশ নিয়ে বেশি ভাবেন, যারা দেশকে বেশি ভালোবাসেন বলে দাবি করেন, তারাই জানেন। তারাই জানুক।

নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার ভেবেচিন্তেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, গ্রহণ করেছেন। এমন একটি সরকারকে বিশ্বাস করতে হবে যে, প্রায় আঠারো কোটি মানুষের এই দেশে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ আছেন, বসবাস করেন স্বপ্ন দেখে। তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, দল নেই। যেটা আছে, সেটা দেশপ্রেম এবং তা কোনো অংশেই কারোর চেয়ে কম নয়। তাদের কথা তো ভাবতে হবে সর্বাগ্রে। ভাবা দরকার।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App