×

মুক্তচিন্তা

সংলাপ থেকে স্বস্তির সুবাতাস বয়ে যাক

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২২ পিএম

আমাদের দেখার বিষয় এসব প্রতিশ্রুতির প্রতি সরকার কতটা শ্রদ্ধাশীল। শুধু যুক্তফ্রন্ট বা বিকল্পধারার নেতারাই নন- দেশের সাধারণ মানুষও এরকম ‘উচ্চ পর্যায়ের’ আলোচনা থেকে বাস্তবসম্মত ফল প্রত্যাশা করে।

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিগত দিনের ভুল বোঝাবুঝি আর সন্দেহ থেকে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে যে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন উভয়পক্ষের মধ্যে ‘আলোচনা’। এই আলোচনা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথকে সুগম করবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষের মনে বাসা বেঁধে থাকা রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে আলোচনার বিকল্প নেই। তাই সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য মনে করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ। এই আলোচনাকে অনেকে আবার সংলাপ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচন কেন্দ্রিক অতীতে কম করে হলেও দশটি সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বলে এরকম রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনাকে সংলাপ বলতে অনেকেই পছন্দ করেন না। তাদের অভিমত হলো সংলাপ সাধারণত নাটক বা প্রহসনের অঙ্গ। গ্রিক দার্শনিক পেটোর রাজনীতিবিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পেটোর সংলাপ’ও (ডায়লগ) নাট্যাকারে রচিত ও সন্নিবেশিত। তবু সংলাপ শব্দটি রাজনৈতিক পরিভাষায় স্থান করে নিয়েছে। উপরন্তু সংলাপ শব্দটি সমকালীন রাজনীতির একটি জনপ্রিয় বাহাসও।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে একটি পত্র দেয়া হয়। সংলাপ বিষয়ে এই পত্র দেয়ার পরপরই আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হওয়া অতীতের ব্যর্থ সংলাপসমূহের কথা সবার মনে পড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সংলাপ নিয়ে তীর্যক, ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক নানা মন্তব্য-ভাষ্য আমাদের চোখে পড়েছে। আবার কদাচিৎ ইতিবাচক প্রত্যাশাও ব্যক্ত হয়েছে। যাই হোক, সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে ড. কামালের পত্রের জবাবে খুব দ্রুতই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আলোচনায় বসার জন্য দিনক্ষণ জানিয়ে গণভবনে আমন্ত্রণ জানান। লক্ষ করার বিষয় যে, ড. কামাল হোসেনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী তার ছোট্ট আমন্ত্রণপত্রে ‘সংলাপ’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘আলোচনা’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। আমন্ত্রণপত্রের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের ফলে সবাই লক্ষ করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী তার চিঠিতে ‘সংবিধানসম্মত’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ সরকারের পক্ষ থেকে প্রকারান্তরে এ কথা আগেই স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বিদ্যমান সংবিধান সমুন্নত রেখেই বহুল কথিত সংলাপ বা আলোচনা থেকে সংকট সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে। যাই হোক, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনার পথ ধরেই যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকেও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশ করে সময় চান। প্রধানমন্ত্রী যুক্তফ্রন্টকেও গণভবনে সংবিধানসম্মত আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণপত্র পাঠান। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি দলের সঙ্গে অর্থাৎ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা কিংবা সাধারণের প্রিয় ‘সংলাপ’ সম্পন্ন করেছেন। আমরা উন্মুখ হয়ে গণভবনের দিকে তাকিয়েছিলাম। সমগ্র জাতির মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল গণভবনে অনুষ্ঠিত হওয়া সেই আলোচনার ফলাফলের দিকে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে সাত দফা ঘোষণা করেছিল তার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট নেতা ও বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীদের সাত দফার মধ্যে বিরোধ তেমন নেই। উভয় দলের ঘোষিত সাত দফার বহিরাবরণ আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা কঠোর মনে হলেও প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘সংবিধানসম্মত’ আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে উভয় দলের গণভবনে আমন্ত্রণ রক্ষা এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করায় সামগ্রিকভাবে দেশে স্বস্তি বিরাজ করছে। একটি বৈঠকের আলোচনা থেকে কোনো সংকটেরই তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব নয়। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দুটি পরস্পরবিরোধী দল বা জোটের নেতৃবৃন্দ স্ব-স্ব দুঃখ, অভিমান, ক্ষোভ, সংক্ষোভ ভুলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সহজভাবে দীর্ঘক্ষণ মুখোমুখি বসেছিলেন। আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে রাজনীতির কঠিন ও কঠোর বিষয়ে আলোচনা করেছেন- আলোচনা করেছেন বিভিন্ন প্রকার দাবি-দাওয়া নিয়েও। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় যা অদৃশ্যপ্রায় ও অসম্ভব কল্পনামাত্র ছিল- সমগ্র জাতি সেরকম একটি দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। আমাদের দেশের অতীতের সংলাপগুলো এমন আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল না এ কথা সবাই স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার সময়ে হওয়া উন্নয়নের কথা বলেছেন, বিএনপি নেতারা তাদের রাজনৈতিক হয়রানির কথা বলেছেন। কিন্তু সামগ্রিক পরিবেশ ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। কেবল নির্বাচন কেন্দ্রিক এ ধরনের আলোচনায় নয়- আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এরকম গুণগত পরিবর্তনের দৃশ্যটিই দেশবাসী দেখতে চায়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও এ ধরনের আলোচনা দেশবাসী প্রত্যাশা করে।

প্রথমদিনের আলোচনা শেষে গণভবন ত্যাগের সময় ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে ‘আলোচনা ভালো হয়েছে’ বললেও একদিনের ব্যবধানে ঐক্যফ্রন্টের অন্য নেতাদের এমনকি ড. কামাল হোসেনের কণ্ঠেও ভিন্ন বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া আলোচনাকে সেই পুরনো প্রহসন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আর বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা থেকে ইতিবাচক কোনো কিছু যেমন অতীতে কখনো পায়নি- তেমনি ১ নভেম্বরের আলোচনা থেকেও ‘সন্তুষ্ট’ হতে পারেনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা থেকেও আওয়ামী লীগ কখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এটিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সৌন্দর্য! বাংলাদেশের রাজনৈতিক নানা উত্থান-পতনের ইতিহাস সামনে এনে বলা যায় যে, বিএনপিকে খুশি করার সাধ্য যেমন আওয়ামী লীগের নেই তেমনি আওয়ামী লীগও বিএনপির কোনো কর্মকা-ে খুশি হতে পারে না। ফলে বিভিন্ন সময় চরম সংঘাতের দৃশ্যও দেশবাসীকে দেখতে হয়েছে। এর পশ্চাতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমান কর্তৃক পরোক্ষ ইন্ধনদান থেকে শুরু করে ২০০৪ সালে তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাসহ নানাবিধ গভীর থেকে গভীরতর কারণ। তাই বর্তমান পরিসরে সবিশেষ উল্লেখ্য, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত না হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিংবা বিশ দলীয় জোট পরস্পর আলোচনায় বসা সম্ভব হতো না- উভয় দলের নেতাকর্মীদের এক টেবিলে মুখোমুখি বসা অসম্ভব-কল্পনা। সুতরাং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়ে আমরা যারা ড. কামাল হোসেনের সমালোচনা করে থাকি তাদের মনে রাখা উচিত অন্তত এই একটি বিষয়ে ড. কামাল হোসেন ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। তবে সামগ্রিকভাবে স্বস্তি জন্য প্রয়োজন আলোচনাকেই সুসংহত করা।

আলোচনার টেবিলে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যা অর্জন সম্ভব হয়নি তা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য জনগণকে হতাশ ও বিভ্রান্ত করতে পারে বিষয়টি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মনে রাখা ভালো। যদিও আমরা আলোচনায় অংশ নেয়া না নেয়া এমনকি তালিকায় নাম থাকার পরও আলোচনায় না যাওয়া বিএনপির নেতাদের মধ্য থেকে কৌশল বদলিয়ে কেবল আন্দোলনেরই ইঙ্গিত শুনতে পাচ্ছি! সবই হতে পারে- তবে যেহেতু আলোচনার আরো সুযোগ আছে সুতরাং সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারই সংকট উত্তরণের প্রধান উপায় হতে পারে। এদিকে ২ নভেম্বর গণভবনে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা শেষে সরকারি পক্ষ বরাবরের মতো বলছেন আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার মতো করে বলেছেন আমাদের তো মনে হয়েছে তারাও বলবেন যে, আলোচনা গঠনমূলক, ফলপ্রসূ ও ভালো হয়েছে। গণভবনের আলোচনা শেষ করে বারিধারার বাসায় ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমাদেরও মনে হয়েছে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের আলোচনা অনেকটাই সফল হয়েছে।

যদিও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন ‘এর সবই প্রতিশ্রুতি’। এখন আমাদের দেখার বিষয় এসব প্রতিশ্রুতির প্রতি সরকার কতটা শ্রদ্ধাশীল। শুধু যুক্তফ্রন্ট বা বিকল্পধারার নেতারাই নন- দেশের সাধারণ মানুষও এরকম ‘উচ্চ পর্যায়ের’ আলোচনা থেকে বাস্তবসম্মত ফল প্রত্যাশা করে। আমরাও প্রত্যাশা করব সরকার তার প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার রক্ষা করে আসন্ন নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণমূলক এবং আনন্দমুখর পরিবেশে সম্পন্ন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে। আলোচনার মানেই হলো ‘দেবো আর নিবো, মিলাবো মিলিবো’।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App