×

মুক্তচিন্তা

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ভোগান্তির শেষ কোথায়?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৬ পিএম

ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক অনিয়ম ও গ্রাহক ভোগান্তি প্রতিকারের পাশাপাশি গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান জরুরি। আর্থিক খাতের এই দৈন্যদশা জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। আর এ অবস্থার পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের যথাযথ মর্যদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ ব্যাংকের গ্রাহক আছে বলে আজকে অনেকেই ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তা। তাই গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও সুদের হার কমাতে খোদ প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার বলার পরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদের হার কমায়নি। পরে অবশ্য সরকারের কয়েক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রথমে সরকারি ব্যাংক ও পরবর্তী সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নামিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও প্রকৃতপক্ষে সব গ্রাহক এ সুবিধা পায়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা সুদের হার কমাতে গড়িমসি করলে সরকার তাদের নানা সুবিধা প্রদান করে নির্দেশ মানতে বাধ্য করেন। আমাদের ব্যবসায়ীরা সব সময় তাদের ক্ষমতা দেখিয়ে আসছেন আমরা গোড়া থেকে এটা দেখে আসছি। এ নিয়ে বেশি কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ দেশের রাজনীতির প্রধান দুই মেরুতে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তারা সিংহভাগই ব্যবসায়ী। তবে সে যে ধরনের ব্যবসায়ী হোক না কেন? তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ী, চাল-ডালের ব্যবসায়ী, ওষুধ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জমিজমা বিক্রি, পত্রিকা-মিডিয়া, মোবাইল ফোন, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের ব্যবসায়ী হোক না কেন, সরকারের নীতিনির্ধারকদের বশীকরণে তাদের হাতে জাদুর বাক্স থাকে। যার কারণে যাবতীয় নীতি প্রণীত হয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ থাকে গৌণ। তবে ব্যাংকের সুদের হার কমানোর ক্ষেত্রে যারা প্রধান ভুক্তভোগী তাদের সিংহভাগই ব্যবসায়ী, সে কারণে বিষয়টি তড়িৎ গতিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক হয়রানি, অনিয়ম বিষয়ে প্রতিকারের জন্য দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিকার পাওয়ার জন্য অভিযোগ আবেদন জানানোর রীতি আছে। যা অনেকটা সরকারি দপ্তরে সিটিজেন চার্টার্ড টাঙানোর মতো। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এন্ড কাস্টমার সার্ভিসেস (এফআইসিএসডি) নামে একটি পৃথক ডিপার্টমেন্টও আছে। একজন মহাব্যবস্থাপক বিষয়টি দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, অতিরিক্ত সুদ, সার্ভিস চার্জ আদায়, গ্রাহক হয়রানি সম্পর্কে তারা কিছু করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না? তবে অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু বিজ্ঞাপন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। কিছু হেলপ নম্বরে ফোন করার জন্য ব্যাংকগুলোতেও সাইনবোর্ড টাঙানো থাকে। আর এই এফআইসিএসডি প্রতি বছর তাদের কার্যক্রমের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকেন। তবে এ প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন আছে। ঠিক কতজন গ্রাহক এখান থেকে প্রতিকার পেয়েছেন তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহের মূল কারণ হলো ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্তার কোনো কথা শুনছে না, সেখানে এই এফআইসিএসডি সেকশনের কথা কতটুকু আমলে নেবে? ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা না শুনলে তারা কিছুই করতে পারে না, সে কারণে শৃঙ্খলা ও গ্রাহক হয়রানির প্রতিকার পাওয়ার বেলায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রতিরোধ্য। বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকেও কোনো কোনো সময় আমলে না নিয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের কাছে দেন-দরবার করে থাকেন। ফলে একজন সাধারণ গ্রাহকের আজাহারি ও কান্না তাদের কানে পৌঁছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম, গ্রাহক হয়রানি, রক্তচোষা সুদ আদায়, নামে-বেনামে সার্ভিস চার্জ আদায় এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। ব্যাংকগুলো লুটপাট, ঋণ প্রদানে অনিয়মসহ নানা রোগে যেমন আক্রান্ত, তেমনি ঋণ প্রদানে উচ্চ সুদ, নামে-বেনামে সার্ভিস চার্জ আদায়, আবার গ্রাহকের টাকায় ব্যাংকের পকেট ভারী করলেও সঞ্চয়ে লাভের পরিমাণ খুবই নগণ্য। যারা ব্যাংকের মালিক তারা যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছেন নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তার দশগুণ তুলে নিচ্ছেন।

ব্যাংকের প্রচলিত ঋণের সুদ নির্ধারণ ও কিস্তি আদায়ের প্রক্রিয়াটির বিষয়ে অনেকে বলবেন এটি পুরো বিশ্বজুড়ে সুদ নির্ধারণ প্রক্রিয়া, সে কারণে বাংলাদেশে এটা পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেখানে আমি বলতে চাই বাংলাদেশ যেখানে দরিদ্র মানুষকে জামানতবিহীন ঋণ দিয়ে ও তা সফলভাবে আদায় করে দেখিয়েছেন। যার কারণে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফল দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল। সে কারণে প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদ নির্ধারণ ও আদায় প্রক্রিয়াটিও পরিবর্তন বাংলাদেশ থেকে শুরু হতে পারে। এখানে প্রচলিত ব্যাংকের ঋণের সুদ আদায় ও গ্রাহক হয়রানির একটি গল্প উপস্থাপন করতে চাই। দেশের সুনামধারী একটি ব্যাংকের গ্রাহক যিনি একটি শপিংমলে জুতার দোকান করতেন, ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ নিলেন ওই ব্যাংক থেকে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থাপক প্রথমে ওডি হিসেবে ঋণ দিলেন পরে তা পরিবর্তন করে এসএমই ঋণে তা পরিবর্তন করে দেন। ওই গ্রাহক তিন বছর প্রতি মাসে মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে ১৬ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর ওই গ্রাহক যখন পুরো ঋণটি শেষ করতে চাইলেন তখন ব্যাংক আরো ১৫ লাখ টাকা দাবি করল? এক পর্যায়ে বিষয়টি ফায়সালা করতে না পেরে ক্যাবের কার্যালয়ে অভিযোগ জানাল, ক্যাব বিষয়টি নিয়ে প্রথমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করার উদ্যোগ নেন। ইত্যবসরে স্থানীয় ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক ওই গ্রাহকের নামে ৫টি মামলা ঠুকে দিলেন। ঋণ নেয়ার সময় জামানত হিসেবে তার জমি বন্ধক রাখা হয় এবং তারিখবিহীন খালি চেক জামানত নেয়া হয় কমপক্ষে ৪০টি। যা দিয়ে আদালতে মামলা রুজু করেন। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আদালত কোনো প্রকার বিচার-বিশ্লেষণ না করে আসামির বিরুদ্ধে পাওনা টাকা আদায়ে সমন নোটিস ইস্যু করেন। এক পর্যায়ে ক্যাব এবং ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে মাত্র ৮ লাখ টাকায় বিষয়টি মীমাংসা হয়। গ্রাহক তার বন্ধককৃত জমি ও খালি চেকগুলো ফেরত পান এবং ঋণ থেকে মুক্তি পান।

দেশের প্রচলিত এনজিওগুলো ঋণের কিস্তি আদায়কালে মূল টাকার সঙ্গে ঋণের সুদের সমন্বয় করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে পুরো সুদ আদায় করে নিয়ে পরে ক্রমান্বয়ে মূল টাকাগুলো সমন্বয় করে থাকেন। যে কারণে একজন ঋণী গ্রাহক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের টাকা দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়ে যান। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কর্মচারীরা দিনে দিনে এয়ারকন্ডিশন বাড়ি, গাড়ির মালিক হয়ে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করতে থাকেন। ব্যাংক মালিকরা প্রতিনিয়ত একের পর এক নতুন ব্যাংক খুলছেন, আর যারা এর জোগান দেন সেই ঋণী/গ্রাহকরা সবকিছু হারিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছেন। ঋণীর নিরাপত্তায় এনজিওগুলোর গ্রাহকরা কোনো কারণে লোকসান দিলে তাকে বর্ধিত ঋণ দিয়ে তার ব্যবসাটি পুনরায় চালু করতে সহায়তা করেন এবং ঋণী কোনো কারণে মারা গেলে তার ঋণটি বিমা থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ঋণ গ্রাহকের যাবতীয় ঋণ মওকুফ করেন। ব্যাংকের বেলায় ঋণী গ্রাহক মারা গেলে তার পরিবার-পরিজনকে সে টাকা পরিশোধ করতে হয়। লোকসান গুনলে তার বিরুদ্ধে সম্পত্তি ক্রোক ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ঋণ আদায় করা হয়। যা খুবই দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। ঋণীর নিরাপত্তা রক্ষায় তাকে বিমার আওতায় পুনর্বাসন করা না গেলে উদ্যোক্তারা হারিয়ে যাবে।

তাই ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক অনিয়ম ও গ্রাহক ভোগান্তি প্রতিকারের পাশাপাশি গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান জরুরি। আর্থিক খাতের এই দৈন্যদশা জাতির অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। আর এ অবস্থার পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের যথাযথ মর্যদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ ব্যাংকের গ্রাহক আছে বলে আজকে অনেকেই ব্যাংকের মালিক ও কর্মকর্তা। তাই গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App