×

মুক্তচিন্তা

ফর্মুলার ঝুলিতে কি আছে

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২৯ পিএম

সমঝোতা হলে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। এবারে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে বিএনপিরও বহু লোক বিশ্বাস করে। মিছিল, সমাবেশ, জনসভা অবাধে হলে গণতন্ত্র চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান সর্বতোভাবে ভাষা পায়। তার ওপর বেগম জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আধ-মরা বিএনপি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাদের জনসমর্থন বেড়ে গেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বাংলাদেশে গুরুতর কিংবা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দল বা দলসমূহের রাজনৈতিক সংলাপের কোনো ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। এবারই প্রথম নির্বাচনের বিষয়াদি নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকারের সঙ্গে বিরোধী ঐক্যফ্রন্ট, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট এবং বিকল্প ধারার সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাইপ লাইনে জাতীয় পার্টিসহ আরো কয়েকটি অপেক্ষাকৃত ছোট রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা নির্বাচন বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বসতে চায়। কথা বলতে চায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া এই সংলাপের ধারা রাজনীতির পরিণত মনস্কতার দিকে যাওয়ারই ইঙ্গিতবহ। অবশ্য দেশে নির্বাচন এলে শুধুমাত্র তবেই সরকারের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সংলাপ হবে এটা কোনো কাজের কথা নয়। যে কোনো গুরুতর কিংবা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনার সুযোগ থাকা উচিত। রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় এখনই পূর্ণতা পেতে পারে। অবশ্য মতবিনিময় শেষে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সরকারেরই।

এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শ্রদ্ধাভাজন ড. কামাল হোসেনের সৌজন্যে যে রাজনৈতিক সংলাপের সূচনা ঘটল, পরবর্তী সময়ে তা যেন বহাল থাকে সেই প্রত্যাশা আমরা করব। বর্তমান সময়ে শুরু হওয়া সংলাপ বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের খুশি করতে হলে ওদের দেয়া ৭ দফা দাবি মেনে নিতে হয়। সেটা মেনে নিতে হলে সংবিধান ও নির্বাচন দুই-ই ড্রাস্টিক্যালি বদল করতে হয়। তবেই নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে।

৭ দফা শুধু সরকার নয়, ঐক্যফ্রন্ট ছাড়া দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ আদৌ মেনে নেবে কিনা, মানলে কতটুকু মানতে পারে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। সরকার তো আকারে-প্রকারে বিএনপির যে ৭ দফা রচিত তা কিছুতেই মানবে না। তবে সংবিধানসম্মত একটা সমঝোতা নিশ্চয়ই হতে পারে।

ড. কমাল হোসেন এর মধ্যে ঘোষণা করেছেন বিএনপির অনেকটা বিপক্ষে গিয়ে যে, তিনি সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করা নিয়ে এমন একটা ফর্মুলা সরকারের কাছে পেশ করতে যাচ্ছেন যা সবাই মেনে নেবে।

ড. কামালের এই প্রচ- আশাবাদ বাস্তবে কতটা সমর্থন পায় তা বলা সহজ নয়। তিনি বিএনপির ৭ দফার নিরিখে কোনো ফর্মুলা দিলে তা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং সম্ভবত যুক্তফ্রন্ট-বিকল্প ধারা সেই ধারণাপত্র মানবে না। আবার ড. কামাল হোসেন যদি সর্বতোভাবে সংবিধান ও সংবিধানের আওতায় গঠিত নির্বাচন কমিশনকে মান্যতা দিয়ে কোনো নির্বাচনী ফর্মুলা পেশ করেন তাহলে সেটা বিএনপি সেই মীমাংসাপত্র কিছুতেই মেনে নেবে না।

কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের এক অংশের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য এবং প্রশংসিত। আর এক মহলের কাছে তিনি খুব একটা সম্মান পান না। ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের চানক্য-মনির সঙ্গে তাকে তুলনা করা হয়। এই মহলের লোকেরা এও মনে করেন এবারের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে কামাল হোসেন এমন একটা ভূমিকা নিতে পারেন যা নাশকতা ও অরাজকতার চূড়ান্ত হতে পারে বললে ভুল হবে না। তবে চিরদিনই তো ধান খেয়ে বুলবুলি পালাতে পারে না। আসন্ন নির্বাচন সেটা এইবারই প্রমাণ করে দিতে পারে।

শোনা যাচ্ছে কামাল হোসেন তার ঐক্যফ্রন্টের দলবল নিয়ে দ্বিতীয়বার সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতে চান। চিঠি যাচ্ছে গণভবনে। ড. কামাল হোসেন বলেছেন এমন ফর্মুলা করা হয়েছে যাতে সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন হবে। তিনি অবশ্য বলেননি তার নির্বাচনী ফর্মুলা সংবিধানসম্মত কিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধাসম্মত না হলে কোনো নির্বাচনী মীমাংসাপত্রই মানবেন না কথাটা তিনি সংলাপের প্রস্তাব গ্রহণ করার সময়ই বলেছিলেন।

তবে শেখ হাসিনা যে সবার অংশগ্রহণে এবারের নির্বাচন করতে চান, সেই মনোভাব নানাভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন। ৪ নভেম্বরের সংবাদপত্রে দেখলাম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধান লঙ্ঘন না করে ভিন্ন উপায়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতেও প্রধানমন্ত্রী রাজি আছেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপি থেকে সুপ্রিম কোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে একটি আবেদন করতে হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষ সে আবেদনের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকে।

অনেকে সংলাপের ধারার কোনো মীমাংসা হবে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও সংলাপে বসে নির্বাচন করার একটা প্রস্তাব শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া যেন ধরেই নিয়েছিলেন তাদের দাবি পূরণ না করে ক্ষমতাসীন সরকার, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় সরকার যাবে কোথায়! নির্বাচন বয়কট করেন বিএনপির এই অদূরদর্শী ও কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তে বিএনপির রাজনীতিতে প্রচণ্ড ক্ষতি ছাড়া লাভ বিন্দুমাত্র হয়নি। সেটা পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া নিজেও স্বীকার করেছেন।

তবে ২০১৪ সালে রাজনীতির বাস্তবতা থেকে বিএনপি কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। সেবারে নির্বাচন হতে না দেয়ার জেদ ও অহঙ্কারে নাশকতা চালিয়ে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করে অগ্নি-সন্ত্রাসে কয়েকশ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেও বিএনপি নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। সংবিধান মেনে সংলাপের সৌজন্যে পাওয়া সুবিধাসমূহ গ্রহণ করে এবারেও বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন ঠিকই হবে। নাশকতা কিংবা টার্গেট কিলিং, বোমাবাজি কিংবা সারা দেশে মানুষ মারার নাশকতায় নামলে বিএনপিও রক্ষা পাবে না। দেশের গরিষ্ঠ অংশের মানুষ স্বভাবতই উন্নয়নের পক্ষে। নৌকার পক্ষে। ড. কামাল হোসেন হুঙ্কার ছেড়েছেন তার কথা না মানলে নাকি ১৪ দলীয় সরকারকে ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে। কামাল হোসেনের ভাষা টিক্কাপাড়ার সন্ত্রাসী কালু মাস্তানের ভাষা বলে মনে হয়। এরকম হুঙ্কার তার নামের প্রতি সুবিচার করে না।

সমঝোতা হলে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। এবারে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে বিএনপিরও বহু লোক বিশ্বাস করে। মিছিল, সমাবেশ, জনসভা অবাধে হলে গণতন্ত্র চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান সর্বতোভাবে ভাষা পায়। তার ওপর বেগম জিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে আধ-মরা বিএনপি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাদের জনসমর্থন বেড়ে গেলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

কামাল হোসেন দ্বিতীয়বার সংলাপ চাইছেন সরকারের কাছে। রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিমাত্র আগ্রহী তার ফর্মুলার ঝোলায় কি আছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সময় ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানে তার শ্বশুরালয়ে অবস্থান করছিলেন। অথচ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সন্ধ্যার দিকটায় ভারতে যাওয়ার পথে কামাল হোসেনের বাসায় যান। অনুরোধ করেন তাদের সঙ্গে যেতে। কামাল হোসেন জানালেন দুয়েকটা পারিবারিক জরুরি কাজ সেরে দুয়েকদিনের মধ্যেই ভারতে যাবেন। এই কাহিনী লেখা আছে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা ইতিহাসের বিচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বইতে।

ক’দিন আগে একটি সংবাদপত্রে জনৈক নিবন্ধ লেখকের লেখায় ড. কামাল হোসেনের পরবর্তী কার্যকলাপের কথা পড়লাম। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কামাল হোসেন সাহেবকে সঙ্গী হিসেবে না পেয়ে খানিকটা হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার পর ড. কামাল হোসেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (এখন বাংলাদেশ) পূর্বপরিচিত পদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তার কাছে টেলিফোন করে বলেন যে, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চালের মধ্যে আছেন। মুক্তিযুদ্ধ-টুদ্ধ তিনি করতে পারবেন না। তাকে যেন সমুচিত নিরাপত্তা দেয়া হয়। পদস্থ পাক সামরিক কর্মকর্তা সেই ব্যবস্থা করেন। পরে পাকবাহিনীর অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তাকে পাকিস্তানে তার শ^শুরালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ড. কামাল হোসেন সম্বন্ধে এরকম আরো বহু কাহিনী আছে যা জানলে মুখ ও মুখোশের পার্থক্য ভালোভাবে বুঝা যায়। এই কামাল হোসেনই হুঙ্কার দিয়েছেন এবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ নির্বাচন না হলে নাকি সরকারকে এমন শাস্তি দেয়া হবে যার নৃশংসতা কল্পনারও অতীত।

কয়েকদিন আগে কামাল হোসেন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ইউ স্টপ বাস্টার্ড। আমি ভাবি সম্মানিত কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত এইরকম সন্ত্রাসী ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন। কি লজ্জা, কি ঘেন্না! কামাল হোসেন নির্বাচনে কি ফর্মুলা দেন, কাদের স্বার্থে দেন সেটা দেখার অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। আমি তাদের একজন। বাংলাদেশে বাঙালিদের কাছে হুঙ্কার তেমন দাম পায় না। দাম পায় যুক্তি। কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় দেশে একটি সংবিধান আছে। তারপরও কেন ফর্মুলার প্রয়োজন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান নিজেও জানেন সংবিধান কোনো রাফ-খাতা নয় যে যখন তখন একটা-দুটা পাতা ছিঁড়ে ফেলা যায়।

ড. কামাল হোসেন এবার খোলাখুলি যোগ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে যাদের প্রধান একদা বাংলাদেশের সংবিধান ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্য অগ্নি-সন্ত্রাসের ভয়াবহ তৎপরতায় নেমেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহও কামাল হোসেনকে কিছুমাত্র বদলাতে পারেনি। দুঃখ রাখি কোথায়!

রাহাত খান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App