×

মুক্তচিন্তা

জেলহত্যা দিবসের স্মৃতিকথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০৯ পিএম

জেলহত্যা দিবসের স্মৃতিকথা

আহমেদ/ফাইল ছবি

জেলহত্যা দিবসের স্মৃতিকথা
প্রতি বছর যখন জাতীয় জীবনে ৩ নভেম্বর ফিরে আসে তখন জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেবের আত্মত্যাগের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে পড়ে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁরা বারবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে নিজেদের জীবন তুচ্ছ-জ্ঞান করে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতা সংগ্রামে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা করে বাংলার মানুষকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করে এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা এবং সবশেষে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পৃথিবীতে বহু নেতা এসেছেন এবং আসবেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা পৃথিবীতে আর জন্মগ্রহণ করবেন বলে আমি কখনো মনে করি না। যে নেতা লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করতেন এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে জেল-জুলুম-অত্যাচার ফাঁসির মঞ্চকে তুচ্ছ মনে করতেন। একবার চিন্তা-ভাবনা করে যে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে যা বলতেন ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতেন না। সেই মহান নেতার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরুর পর মুহূর্তে ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন সেলে নয় মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমাদের চিন্তা-চেতনা-ভাবনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করেছি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় চারনেতা। যেদিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেদিন আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি। ভয়ঙ্কর-বিভীষিকাময় দুঃসহ জীবন তখন আমাদের! ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে ফাঁসির আসামিকে যেখানে রাখা হয় সেখানেই আমাকে রাখা হয়েছিল। সহকারাবন্দি ছিলেন ‘দি পিপল’ পত্রিকার এডিটর আবিদুর রহমান। যিনি ইতোমধ্যে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আমরা দুজন দুটি কক্ষে ফাঁসির আসামির মতো জীবন কাটিয়েছি। হঠাৎ খবর এলো, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। কারারক্ষীরা সতর্ক। ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার ছিলেন শ্রী নির্মলেন্দু রায়। চমৎকার মানুষ ছিলেন তিনি। কারাগারে আমরা যারা বন্দি ছিলাম তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভ‚তিশীল। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন বারবার কারাগারে বন্দি ছিলেন নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নির্মলেন্দু রায়কে কাছে টেনে সবসময় আদর করতেন। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মিস্টার ফারুক যিনি এখন প্রয়াত আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাতে কেন? তিনি বললেন, ‘ঢাকা কারাগারে আপনাদের প্রিয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চতুর্দিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’ আমি বললাম, না, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাকে যদি হত্যাও করা হয়, আমি এখান থেকে এভাবে যাব না। পরবর্তীকালে শুনেছি সেনাবাহিনীর একজন মেজর সেই জেলখানার সামনে এসে কারাগারে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু রায় বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেব না।’ কারাগারের চতুর পাশে সেদিন যারা আমাকে রক্ষার জন্য ডিউটি করছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠী ওদুদ আমরা একসঙ্গে এমএসসি পাস করেছি এবং দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩-এ যিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারাগারকে রক্ষা করার জন্য। আমি নির্মলেন্দু রায় এবং ওদুদের কাছে ঋণী। ছাত্রজীবন থেকে আমি জাতীয় চার নেতাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি। তাঁদের আদরে-স্নেহে আর রাজনৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবন আমার ধন্য। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেদিন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, আমরা সেদিন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। যার নেতৃত্বে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, যার জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না, তাকে বাংলার মাটিতে এভাবে জীবন দিতে হবে এটা আমরা কখনোই ভাবিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দি। ১৫ আগস্টের পরদিন আমার বাসভবনে খুনিরা এসে আমাকে তুলে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। পরবর্তী সময় জেনারেল শফিউল্লাহ এবং প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল তিনি তখন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার তাদের প্রচেষ্টায় রেডিও স্টেশন থেকে আমাকে বাড়িতে আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীরের ওপর দিয়েই আমায় টেনে নিয়েছিল ঘাতকের দল। পরদিন শাফায়াত জামিল এবং মেজর সাখাওয়াত হোসেন (পরবর্তী সময় নির্বাচন কমিশনার, অব.) আমার গৃহবন্দি অবস্থায় বাসায় এসে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেন। আমার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফায়াত জামিল নিজের লেখা বইতে সেসব উল্লেখ করেছেন। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি জনাব ই এ চৌধুরীর মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান এবং আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খুনি খোন্দকার মোশতাক আমাদের ভয়-ভীতি দেখান এবং বলেন, যদি তাকে সহযোগিতা না করি তাহলে তিনি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদের আপনার রক্ষা করতে হবে না। আমাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করে আমরা খুনি মুশতাকের সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আগস্টের ২২ তারিখ জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের অনেক বরেণ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল হত্যা করার জন্য। যে কোনো কারণেই হোক ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। গৃহবন্দি অবস্থা থেকে একদিনে আমাকে, জিল্লুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দি রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে খুনিচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে চোখ ও হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রেখে আসে। পরদিন সিটি এসপি আবদুস সালাম ডাক্তার এনে আমার চিকিৎসা করান। পরে আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে এবং জিল্লুর রহমান ও প্রিয়নেতা রাজ্জাক ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ময়মনসিংহে কারারুদ্ধকালে জেলখানার জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুর দুঃসংবাদটি শুনে মন ভারাক্রান্ত হয় ও অতীতের অনেক কথাই মানসপটে ভেসে ওঠে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতীয় চার নেতার কত অবদান। স্মৃতির পাতায় তার কত কিছুই আজ ভেসে ওঠে। দল পুনরুজ্জীবনের পর ১৯৬৪তে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সাধারণ সম্পাদক এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাই যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দেয়ার পর ফেব্রুয়ারির ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু মুজিব সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সহসভাপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অন্যতম সহসভাপতি এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু যোগ্য লোককে যোগ্যস্থানে বসাতেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ছয় দফার সমর্থনে জনসভা করেন এবং যেখানেই যান সেখানেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। খুলনায় জনসভা শেষে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়; সিলেটে জনসভা, সেখানেও গ্রেপ্তার; ময়মনসিংহে গেলেন, গ্রেপ্তার হলেন। কিন্তু লাগাতার গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালিয়েও আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে দমাতে পারেনি। অবশেষে ৮ মে, নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষে ধানমন্ডির বাসভবনে ফেরামাত্রই তথাকথিত ‘পাকিস্তান রক্ষা আইন’-এ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাইসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এর প্রতিবাদে আমরা ১৯৬৬-এর ৭ জুন হরতাল পালন করেছিলাম। সফল হরতাল পালন শেষে এক বিশাল জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঙালির ছয় দফা তথা স্বাধিকার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে অপূর্ব সুন্দর বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা, তাজউদ্দীন আহমদ দক্ষ সংগঠক এবং কামরুজ্জামান সাহেব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের এমএনএ হিসেবে পার্লামেন্টে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের তথা স্বাধিকারের দাবি তুলে ধরতেন। ১৯৬৮তে কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তাজউদ্দীন ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় দলের শীর্ষ নেতারা কারাগারে বন্দি ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাইরে ছিলেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মরহুম আহমেদুল কবীরের বাসভবনে উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব সংক্ষেপে উঅঈ-এর সভা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমি যখন ১১ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করছি তখন ন্যাপ নেতা মাহমুদুল হক কাসুরি ১১ দফা কর্মসূচি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘তোমরা ১১ দফা কর্মসূচিতে শেখ মুজিবের ৬ দফা হুবহু যুক্ত করেছো। সুতরাং তোমাদের ১১ দফা সমর্থনে প্রশ্ন আসবে। তার এই বক্তব্যের পর বলেছিলাম, আমরা বাঙালিরা কীভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা জানি। আপনারা সমর্থন না করলেও এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রিয়নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করব। আমার এই দৃপ্ত উচ্চারণের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমায় বুকে টেনে পরমাদরে বলেছিলেন, ‘তোমার বক্তব্যে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।’ আজ সেসব কথা ভাবলে চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এবং কামরুজ্জামান সাহেব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কে কোন পদে পদায়িত হবেন বঙ্গবন্ধু তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আমিও মাত্র ২৭ বছর বয়সে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৭১-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং কামরুজ্জামান সচিব, চিফ হুইপ পদে ইউসুফ আলী এবং হুইপ পদে যথাক্রমে আবদুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এ জন্য মনসুর আলীকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সেট-আপ করা ছিল। কিন্তু ১৯৭১-এর ১ মার্চে পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক একতরফাভাবে স্থগিত হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্ব। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সর্বাত্মক স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হয় অসহযোগের দ্বিতীয় পর্ব। বিশ্বে এমন অসহযোগ কখনো দেখেনি কেউ! বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করেছেন অসহযোগের প্রতিটি দিন। আমাদের প্রয়াত নেতা খুলনার মোহসীন সাহেবের লালমাটিয়াস্থ বাসভবনে বসে আমরা কত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন আমরা কে কোথায় গেলে কি সাহায্য পাব। ১৯৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চারজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠালেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। সেখানে জাতীয় চার নেতাও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘পড়ো, মুখস্থ করো।’ আমরা মুখস্থ করলাম একটি ঠিকানা, ‘সানি ভিলা, ২১, রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কোলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানেই হবে তোমাদের জায়গা। ভুট্টো-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা দেবে না। আমি নিশ্চিত ওরা আক্রমণ করবে। আক্রান্ত হলে এটাই হবে তোমাদের ঠিকানা। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করবে।’ বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতারকে তিনি আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু তাকে আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে। সেই পথেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, মণি ভাই এবং আমাকে আবু হেনা সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার এই রাজেন্দ্র রোডেই আমরা অবস্থান করতাম। আর ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থান করতেন আমাদের জাতীয় চার নেতা। নেতাদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারের ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করা হয়েছিল। জাতীয় নেতাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব ভুল বোঝাবুঝি দূর করে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে প্রিয় মাতৃভ‚মিকে আমরা স্বাধীন করেছি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, স্বাধীনতা ঘোষণার পর যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন এই জাতীয় চার নেতাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার পরিচালনা করেন ও বিজয় ছিনিয়ে আনেন। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, সেই পরিষদে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুমোদন করে তারই ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করেন। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন এবং পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভ‚মিকে হানাদার মুক্ত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শিতার সঙ্গে সুন্দর-সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আমাদের চারজনকে মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে। আমাদের চারজনের কাজ ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আজকে আমার সেসব কথা মনে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে আমি বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, রণাঙ্গনে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছি। একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি থাকতাম কলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ব্যারাকপুরে, মণি ভাই আগরতলায়, সিরাজ ভাই বালুর ঘাটে আর রাজ্জাক ভাই মেঘালয়ে। মেজর জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে দেরাদুনে ছিল আমাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুজিব বাহিনীর জন্য ভারত সরকারের যত সাহায্য-সহযোগিতা সেসব আমার কাছে আসত। আমি আবার সেগুলো এই তিন নেতার কাছে পাঠিয়ে দিতাম। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে একটি বিশেষ হেলিকপ্টারে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভ‚মিতে প্রত্যাবর্তন করি। ২২ ডিসেম্বর জাতীয় চার নেতা ফিরে এলেন। আর ৯ মাস ১৪ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের পরিপূর্ণতায় জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ২২ তারিখ শত্রুমুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের নেতাদের তথা জাতীয় চার নেতাকে আমরা বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাই। ১৯৭২-এর ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমেদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে আমি মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলাম। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষদিন পর্যন্ত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এমনকি নিষ্পাপ রাসেলকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। যাতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করতে না পারে, সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই খুনিরা শিশু রাসেলকে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, জাতীয় চার নেতা হত্যারও মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের কেউ যেন নেতৃত্ব দিতে না পারে। খুনিরা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য হয়ে ধ্বংস হবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আমাদের প্রিয় বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলেন। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার হাতে আওয়ামী লীগের সংগ্রামী পতাকা তুলে দিয়ে আমরা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই পতাকা হাতে নিয়ে তিনি নিষ্ঠা-সততা-দক্ষতার সঙ্গে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগকে গণরায়ে অভিষিক্ত করে সরকার গঠন করেন এবং অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। আবার ২০০৯-এ সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে তিনি নিয়ে গেছেন। আজ আন্তর্জাতিক বিশ্ব মনে করে বিস্ময়কর উত্থান এই বাংলাদেশের! যারা একদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বাংলাদেশের সবল-সমর্থ আর্থ-সামাজিক বিকাশে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছি। শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়িত হলে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে প্রিয় মাতৃভ‚মি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হবে এবং ২০৪১-এ হবে ‘উন্নত বাংলাদেশ’। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করেছিলেন সেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে ধাবমান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা অব্যাহত থাকা সত্তে¡ও দেশের কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি ঘটছে। যদিও মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের ওপর বাড়তি চাপ, তথাপি আমাদের হৃদয়বান প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত-নিরাশ্রয় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের এই মহতী ভ‚মিকার প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মর্যাদাপূর্ণ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভ‚ষিত করেছে।জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। মহান নেতাদের সেই চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই নেতাদের আত্মা চির শান্তি লাভ করবে এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই নিয়োজিত। তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App