×

মুক্তচিন্তা

জেলহত্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেয়ার চক্রান্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:২৪ পিএম

খন্দকার মুশতাক ঠাণ্ডা মাথার খুনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার লাশ ফেলে রেখে তিনি নির্বিকার ক্ষমতায় এসে বসেন। জেল হত্যাকাণ্ডের পর তিনি মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এই অজুহাতে তড়িঘড়ি করে ৫ নভেম্বর জেলহত্যার সপক্ষে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যকে খন্দকার মুশতাক বাগে এনে ফেলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মুশতাক তড়িঘড়ি করে নতুন সরকার গঠন করেন। সে মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্য কেউ রশিদ-ফারুক চক্রের নৃশংসতার ভয়ে, কেউ ক্ষমতার লোভে, কেউবা আগে থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা-ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার সুবাদে খন্দকার মুশতাকের সরকারে যোগ দেন। মুশতাকের সরকারে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু সরকারের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ।

বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় মুশতাক সরকারের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ দেয়া সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহকে সরিয়ে রশিদ-ফারুক চক্রের পরামর্শে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সেনাপ্রধান করা হয়।

অন্যদিকে জেনারেল জিয়ার সমর্থন থাকায় ঢাকার চার হাজার সৈন্যের ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের অধীন হলেও রশিদ-ফারুক তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও বীরউত্তম সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও তাদের কাছে অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। মূলত খন্দকার মুশতাক, তার মন্ত্রিসভা ও তরুণ মেজররা গণগ্রেপ্তার ও হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি সময় পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে শীতল রাখতে সক্ষম হলেও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শান্ত রাখতে পারেনি।

অন্য সিনিয়র কর্মকর্তারাও রশিদ-ফারুকের কর্মকাণ্ড দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের কারো কারো মধ্যে ক্ষমতার মোহ তৈরি হয়ে যায়। রশিদ-ফারুকের চোখের সামনে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা মেনে নেয়া যায় কী করে! কাজেই তারা এর একটি প্রতিকার খুঁজছিলেন।

এ বিষয়টি লে. কর্নেল এম এ হামিদ তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ গ্রন্থে এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘জুনিয়ার মেজরদের সফল অভ্যুত্থান ক্যান্টনমেন্টের কিছু সিনিয়র এমনকি জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতায় আরোহণের নতুন প্রেরণা জোগালো। সবাই সবাইকে ডিঙিয়ে টেক্কা দিয়ে কেউ চিফ, কেউ রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল। দেশের সর্বোচ্চ পদটি এখন বন্দুকের নলের ধরাছোঁয়ার নাগালে বলে মনে হতে লাগল।’ এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের মধ্যরাতে ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসারের সহযোগিতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক রক্তপাতহীন সেনা-অভ্যুত্থান ঘটে যায়। বন্দুকের নলের জোরে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে পদত্যাগপত্রে দস্তখত নিয়ে নতুন সেনাপ্রধান হন খালেদ মোশাররফ।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। তিনি ট্যাংক-কামান বঙ্গভবন ও শহর থেকে সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো, বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশিদের কার্যক্রমের অবসান ঘটানো এবং তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনে ‘চেইন ইন কমান্ড’-এর অধীন করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃত অর্থেই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর খন্দকার মুশতাক ও রশিদ-ফারুক চক্রের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

খন্দকার মুশতাক উপলব্ধি করেছিলেন, সে সময় ‘চেইন ইন কমান্ড’ মেনে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেলে তার সরকার ও ক্ষমতার নেপথ্য সামরিক শক্তির অবসান ঘটবে।

অন্যদিকে বঙ্গভবনে অবস্থানরত রশিদ-ফারুক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ঘাবড়ে যায়। তারা বুঝেছিল যে, ‘চেইন ইন কমান্ড’ মেনে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেলে তাদের বিড়ম্বনার শেষ থাকবে না। তাদের কোট মার্শালের ব্যবস্থাও হতে পারে। বেগতিক অবস্থা বুঝতে পেরে তারা বঙ্গভবনের একচ্ছত্র দখল-ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার বিপরীতে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়।

পরবর্তীকালে জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রশিদ ও ফারুক চক্রকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেন। কিন্তু তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর খন্দকার মুশতাক খুবই ভেঙে পড়েন। যদিও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নেয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তার ক্ষমতা হারানো ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল না।

২১ জন সদস্য খন্দকার মুশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও মুজিব সরকারের চার মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামান যোগ দিতে সম্মত হননি। খন্দকার মুশতাক আহমেদ এই চার নেতাকে তার ক্ষমতার ব্যাপারে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছিলেন।

ফলে তার নির্দেশে এই চার নেতাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অপ্রত্যাশিত অভ্যুত্থান এবং তার বিশ্বস্ত রশিদ-ফারুক চক্রের ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ার ঘটনা তাকে নতুন ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তিনি এ বিষয়টি তার নিকটাত্মীয় কর্নেল রশিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারপর চার জাতীয় নেতাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩ নভেম্বর রাত ২টায় ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুত্থানের সংবাদ পেয়েই সে রাতেই কর্নেল রশিদ-ফারুক চক্র রাজনীতির ওপর শেষ আঘাত হানে।

এ চক্রের পরিকল্পনা মতো ৩ নভেম্বর ভোর ৬টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এইচ এম কামরুজ্জামানকে একটি কক্ষে জড়ো করে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

জেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় খন্দকার মুশতাক প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। সে বিষয়টি সম্পর্কে ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান যা বলেন, তার মূল কথা ছিল এমন: রাত দুটোর দিকে কারা আইজি তাকে ফোন করে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। তিনি দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে গিয়ে দেখেন, একটি পিকআপে কয়েকজন সেনাসদস্য সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। সেনাসদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দেয়। সে সময় একটি ফোন আসে। আমিনুর রহমান নিজে ফোন ধরেন। তখন তাকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট আইজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আইজি সাহেব কথা বলে জানালেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছেন ‘আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর’।

মূলত খন্দকার মুশতাক কারা কর্তৃপক্ষকে বঙ্গভবন থেকে ফোন করে সেনাদলকে জেল-অভ্যন্তরে প্রবেশের এবং তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য নির্দেশ দেন।

এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমেদ ‘জেলহত্যার পূর্বাপর’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘বঙ্গভবন থেকে খন্দকার মুশতাক ও মেজর আবদুর রশিদের নির্দেশে রাতের অন্ধকারে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই দুজন হত্যাকারীর জন্য জেলগেট খুলে দিতে কারাগারের আইজিকে হুকুম দেয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় এসে জেল হত্যাকাণ্ডের ওপর তথ্য সংগ্রহের সময় ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক, যাকে খালেদ মোশাররফ জেলহত্যার তদন্তে নিয়োগ করেছিলেন, তিনি এই তথ্য আমাকে ১৬ জুন, ১৯৮৭ সালে সাক্ষাতে দিয়েছিলেন।

পরে তো ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ নিহত হওয়ার পর এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করে জেলহত্যার তদন্ত বন্ধ করে দেয়।’

খন্দকার মুশতাক ঠাণ্ডা মাথার খুনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার লাশ ফেলে রেখে তিনি নির্বিকার ক্ষমতায় এসে বসেন। জেল হত্যাকাণ্ডের পর তিনি মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এই অজুহাতে তড়িঘড়ি করে ৫ নভেম্বর জেলহত্যার সপক্ষে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যকে খন্দকার মুশতাক বাগে এনে ফেলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা ১৯৭১ সালে ব্যর্থ হওয়া খন্দকার মুশতাককে পাকিস্তান ফেডারেশন গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করছিলেন। অধিকতর তরুণ ও কিছু বিক্ষুব্ধ নেতা সে সময় ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন।

কিন্তু দেশের মাটিতে বসে জাতীয় চার নেতা খন্দকার মুশতাকের স্বপ্নকে ধিক্কার জানিয়ে তার মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকার করেন। বিষয়টি খন্দকার মুশতাকের মেনে নেয়ার মতো ছিল না। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় চার নেতাকে হত্যার আদেশ দেন তিনি। ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা ছিল মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেয়ার আরেকটি গভীর চক্রান্ত।

অধ্যাপক হাসানুর রশীদ : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বিশ্ব ইতিহাস কেন্দ্র ও জাদুঘর, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App