×

মুক্তচিন্তা

ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:১৬ পিএম

১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও সমান মর্যাদাদানের দাবি জানান। এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এই সূত্রে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

আজ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মজয়ন্তী। ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইলে তার জন্ম। বহির্বিশ্বে এই বছর প্রথম তার জন্মদিন পালিত হচ্ছে নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে। সদ্য গঠিত ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদ, ইউএসএ’ এই উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে এই মহান নেতার জন্মদিন কতটা সাড়ম্বরে পালিত হয় জানি না, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে কতটা সম্মান জানানো হয় তাও বোধগম্য নয়, তবে প্রবাসে এখন থেকে হবে বলে পরিষদ নেতারা জানিয়েছেন। হয়তো ভবিষ্যতে এর ব্যাপ্তি বাড়বে, দেশে দেশে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মদিন পালিত হবে।

১৯৯৪ সালের ১৮ জানুয়ারি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থের জন্য একটি বাণী দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেন : ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার যথাযথ মর্যাদার দাবি করেছিলেন। ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বলিষ্ঠ হয়েছিল। যার পরিণতি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রূপ নেয়, মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম সারির শহীদের মধ্যে একজন। সমগ্র জাতি তার কাছে ঋণী, সেই মহান পুরুষের স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তার আত্মত্যাগ ও মহানুভবতা জাতি চিরকাল স্মরণ করবে।

দেরিতে হলেও জাতি হয়তো তাকে স্মরণ করতে শুরু করেছে। দেশের বাইরে প্রবাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মদিন পালন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জানা যায়, আগামী বছর ২১ এপ্রিল রবিবার পরিষদ প্রথমবারের মতো ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক বক্তৃতা’ চালু করবে। শ্রীদত্তের নাতনি এরোমা দত্ত তাতে উপস্থিত থাকবেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিশেষজ্ঞ টেনেসির অস্টিন পিয়ে স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান মানিক ভাষণ দেবেন।

অভিযোগ আছে, দেশে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অবহেলিত। এ দৈন্যতা কেন? বঙ্গবন্ধু যখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান স্বীকার করে গেছেন, তখন তো আর কথা থাকে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায় : ‘৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সাল। করাচিতে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সভায় পাকিস্তানের সংবিধান নিয়ে বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেই বিষয়েও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হলো বাংলা। লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আমরা দেখলাম বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার’।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনীর টীকাভাষ্যে বলা হয়েছে : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও সমান মর্যাদাদানের দাবি জানান। এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এই সূত্রে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তিনি আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলা সরকারের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলায় কথা বলে, তাই আমার বিবেচনায় বাংলা হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা।’ তার এই বক্তব্যকে জিন্নাহর ‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বলা যায়। আমরা চাই বা না চাই, ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে গেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। একুশে পদক পাননি। পাওয়া উচিত, মরণোত্তর একুশ দিলে ক্ষতি কি?

দেশে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। হওয়া উচিত। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ তার। মিডিয়া দায়িত্ব নিয়ে তার অবদান মানুষকে জানাতে পারে। বাঙালি তাকে চেনেনি, কিন্তু পাকিস্তানিরা ঠিকই চিনেছিল এবং তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তাকে বন্দি করে এবং একপুত্রসহ হত্যা করে? জানা যায়, তার কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ার বাড়িটিও অবহেলিত? বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারিভাবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর কাজ হওয়া উচিত। ভাষাভিত্তিক দেশ বাংলাদেশ। আর এই ভাষার পক্ষে প্রথম লড়াই তার। তাকে অবহেলা মানে ভাষাকে, দেশকে অবহেলা। জাতির এই যোগ্য সন্তানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন করা হোক।

শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App