×

মুক্তচিন্তা

বিচারপতির বিচার কে বা কারা করবে?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৬ পিএম

ইতোমধ্যে স্ট্যাচু অব লিবার্টির গা ঘেঁষে মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রত্যাশার জল গড়াতে থাকবে। বিশ্বজুড়ে ঢাকঢোল পেটানো হবে মার্কিনি গণতন্ত্রের মহিমাকীর্তনে। সমালোচকরা লিখতে থাকবেন যুক্তি তথ্যের সমাহারে ঋদ্ধ রচনাদি। ফলাফল একমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব, অন্য কোনো পথে নয়। ততদিন ক্রিস্টিনা ফোর্ডদের মর্মবেদনা লালন করতেই হবে। সুবিচার দূরে থাক বিচারপতিদের অবিচারের বিচার হবে না।

উত্তর আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রী দেশ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র সুপরিচিত। তার নান্দনিক প্রতীক একটি চমকপ্রদ শিল্পকর্ম ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’। ইংরেজি ‘লিবার্টি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘মুক্ত ও স্বাধীনতা’ দুই-ই বোঝায়, যদিও মুক্তি শব্দটির অভিধা ব্যাপক। যেমন দেশ, ব্যক্তি, সমাজ, প্রথা বা বন্দিদশা থেকে মুক্তি। স্বৈরতন্ত্র বা প্রভুত্ববাদ থেকে মুক্তির প্রশ্নটিও এর এখতিয়ারে।

ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত আমেরিকায় দুটো নৈতিক পরিবর্তন- একটি রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক, অন্যটি সামাজিক। এর প্রকাশ প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের গণতন্ত্রবিষয়ক তাৎপর্যপূর্ণ তাত্ত্বিক ঘোষণায়, সেই সঙ্গে দাসপ্রথা নিরসনের অনুরূপ ঘোষণায়। দুটো ক্ষেত্রেই বাস্তবে ভিন্ন আচরণ। আর নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি স্বতন্ত্রভাবে উঠে আসেনি, যদিও তা পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্গত। কিন্তু সমাজে তখন নারী নির্যাতন ছিল যথেষ্ট, সর্বাধিক প্রকাশ কৃষ্ণাঙ্গ নারী নির্যাতনে, যৌন লাঞ্ছনায়।

তত্ত্ব ও বাস্তবের এই বৈপরীত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সূচনাকাল থেকে চলে এসেছে, নারী নিগ্রহ এখন পর্দার অন্তরালে মূলত শ্বেতাঙ্গ নারীর ক্ষেত্রে। তবে কৃষ্ণাঙ্গ নারীর ক্ষেত্রে তা অবাধ। বর্ণবাদী পাপ থেকে আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজ এখনো মুক্ত হতে পারেনি। আধুনিকতা ও জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তির গরিমা সেই বৈপরীত্যের অবসান ঘটাতে সামাজিক স্বচ্ছতা তৈরি করতে শেখায়নি মার্কিনি রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার সমাজকে। তা সত্ত্বেও সমাজে প্রচলিত জীবনাচরণের কিছু স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধা এবং তেমনি কিছু আইনি ব্যবস্থার কারণে বিদেশিদের চোখে গণতন্ত্রী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তাই দেশটি তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসী তরুণদের চোখে স্বপ্নের ভুবন। অবশ্য এর নেপথ্য কারণ এখানে অর্থবিত্ত অর্জনের সামাজিক সুবিধা যদিও তা অনেক শ্রমের বিনিময়ে। এই সামাজিক অর্থ সচ্ছলতায় আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। উদাহরণ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত দারিদ্র্যপীড়িত ঘেটু এলাকা। সেখানে আছে পুলিশি পীড়ন ও সুবিচারের অভাব। এসব বৈপরীত্যের মধ্যে মূল আলোচ্য বা যৌন হয়রানির ইতিহাস যা কখনো প্রকাশ্যে এলেও পুরুষতান্ত্রিক শক্তির প্রভাবে সুবিচার পায় না। মাঝেমধ্যে তা বিতর্কের সূচনা ঘটায় সংবাদপত্রের কল্যাণে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় শাসনযন্ত্রে, এমনকি বিচার বিভাগে ন্যায়নীতি ও সুবিচারের অভাব নারীর যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে, হোক সে নারী শ্বেতাঙ্গ। সমস্যা হলো বিচারপতির বিচার কে করবে?

দুই. আপাতত মার্কিনি সমাজের অন্দরমহল তথা এর অভ্যন্তরীণ ন্যায়নীতি-গণতন্ত্র-সুশাসন নিয়ে কিছু কথা বলাই এ ভূমিকার উদ্দেশ্য। বহিরঙ্গে ‘টিপটপ’ পরিচ্ছন্ন মার্কিনি সমাজের উচ্চস্তরে কত যে ‘এত্তা জঞ্জাল’ বা পাঁক তা মধ্য স্তরের মানুষের ভাবনার অতীত। মাঝেমধ্যে দু’চারটে ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সামাজিক মহলে বিস্ফোরণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সাংবাদিকদের কল্যাণে, কখনো ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে। কিন্তু সমাধান বা সুবিচার বিরল ঘটনা।

তেমনি একটি ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেট কাভানার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ। এ হলো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহু ন্যায়নীতিবিরোধী কর্মকা-ের একটি। বিবিসির সংবাদভাষ্য অনুযায়ী কাভানাকে বিচারপতি হিসেবে মনোনয়নের কথা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে আসে। কিন্তু যথারীতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অনড় তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যে।

এক সময় তার বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু সেসব অভিযোগ হালে পানি পায়নি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার একটি বড় স্বাতন্ত্র্যবাদী অনৈতিক দিক সমাজে প্রবল- তা হলো পুরুষদের যৌন ব্যভিচারকে গুরুত্ব না দেয়া, দ্বিতীয়ত, যৌন অনাচারের দায়েও পুরুষের বদলে নারীকে দোষী সাব্যস্ত করা, যত চাপ বা শাস্তি তারই। হোক তা সামাজিক বা ন্যায়নীতির বিচারে।

এ অবিচার থেকে মুক্ত নয় অতি আধুনিক উন্নত বিশ্ব- তথা ইউরোপ-আমেরিকা। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ যদিও এ ব্যাপারে নমনীয়- অর্থাৎ এসব কারণে উচ্চপদধারীদের স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করতে দেখা যায়, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা বলা যায় বিরল ঘটনা।

স্বভাবতই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার কাভানা বিষয়ক সিদ্ধান্তে অটল, পুরুষতান্ত্রিক চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটিয়ে। কিন্তু এতসব অভিযোগ- বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার মার্কিন সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটিতে আবেগময় সাক্ষ্যের কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঘটনার তদন্তের জন্য এফবিআইকে নির্দেশ দিতে হয়।

এফবিআই বরাবরই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপছন্দের তালিকায়। তাই তদন্ত কমিটি ফাঁসিয়ে দিতে এতদিনের আগেকার ঘটনা তদন্তে সময় নির্ধারিত মাত্র সাত দিন। এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বভাবসুলভ স্বৈরাচারী আচরণের উদাহরণ হিসেবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কাভানার বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ নিশ্চিত করা হলো।

বিস্ময়ের কিছু নেই যে সংবাদে প্রকাশ- এ বিতর্কে কাভানার পক্ষে অবস্থান নেয় প্রভাবশালী সিনেটররা। আবারো সেই পুরনো পুরুষতান্ত্রিক শক্তির প্রকাশ। যদিও এ ঘটনা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক প্রকাশ পায় যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলের একাংশে এবং সংবাদপত্রের পাতায়। বাংলাদেশের সংবাদপত্রেও এ ঘটনা নিয়ে লাগাতার কয়েকদিন খবর ও প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, এই তো মাত্র দিনকয় আগে।

তিন. যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা প্রায়শ ঘটে থাকে ‘ফ্রি সোসাইটির’ সুযোগ নিয়ে, সাধারণ পার্টিতে অত্যধিক সুরাপানের কারণে বা সুযোগে, অফিসে ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে আচরণে, সামরিক বাহিনীর নারী সদস্যদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে। এসব বোধগম্য কারণে সাধারণত প্রকাশ পায় না।

এ দেশের মতোই বিশে^র সর্বত্র তারুণ্যে বা যৌবনে লাঞ্ছিত নারীরা সামাজিক অপবাদের ভয়ে এসব ঘটনা প্রকাশ করেন না, যন্ত্রণা মনোগহনে লালন করেন, হয়তোবা অতিরিক্ত বন্ধুর কাছে ক্বচিৎ তা প্রকাশ করেন মনোভাব লাঘব করতে। বিশ্বজুড়ে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার কারণে নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচার হরহামেশা ঘটে চলেছে এবং নারীকে ঘরে-বাইরে তা মেনে নিতে হচ্ছে। ক্বচিৎ বিশেষ অবস্থায় হয়তোবা সুবিচার পায় লাঞ্ছিত নারী।

এটা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বহুদৃষ্ট বৈশিষ্ট্য। সেখানে সভ্যতা, আধুনিকতা, মানবাধিকার, জেন্ডার সমানাধিকার জাতীয় শব্দগুলো কাগজে-কলমে ধরা থাকে, ক্বচিৎ ন্যায় বিচার অস্বীকারের উপায় নেই যে, বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সমাজে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিভিন্ন স্তরে, নানা খাতে। তেমনি পরবর্তীকালে একাধিক সমাজতন্ত্রী দেশে। বর্তমান এশিয়ার নারী সমাজে কি সে ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত বা জ্ঞাতরা মনে রেখেছেন সেই অসাধারণ পরিবর্তনের কথা?

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে সমাজ আপাতবিচারে আধুনিক ও সুসভ্য হলেই কি সব সময় সেখানে নারীর সর্বাত্মক নিরাপত্তা ও নৈতিক অধিকার নিশ্চিত হয়? তথ্য ও উদাহরণ বলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় তা হয় না। হতে গেলে সেখানে প্রয়োজন হয় সমাজ বদলের, বিশেষ করে নারীবান্ধব সমাজব্যবস্থা পত্তনের। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশগুলো শিক্ষা ও অন্যদিকে নারীর বাহ্য চলাফেরার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেও মূল সমস্যাটির গোড়ায় হাত দেয়নি। বরং তাতে জল ঢেলে পুষ্টি জুগিয়েছে।

পূর্বোক্ত অধ্যাপিকার লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা সিনেট কমিটির হাতে ধামাচাপার উপলক্ষে পত্রিকায় এক প্রতিবেদক ১৯৮১ সালের একটি অনুরূপ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এমন শিরোনামে : ‘সাতাশ বছরেও পাল্টায়নি আমেরিকা।’ প্রকৃত সত্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিরাজমান সমাজ ব্যবস্থায় ২৭ বছরে কেন, ১২৭ বছরেও পাল্টায়নি মার্কিনি শাসন ব্যবস্থা, তার বিচার ব্যবস্থার নৈরাজ্য, তার ন্যায়নীতির ঘাটতি। এর সূচনা গোড়া থেকে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ব্যাপক যৌন নির্যাতনের ইতিহাসে, সেই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার অনৈতিকতায়। তৎকালীন কিছু নিরপেক্ষ সাহিত্যকর্ম সেসব উদাহরণ ধরে রেখেছে।

তাই ২৭ বছরে আমেরিকা পাল্টাবে, এমন প্রত্যাশার কোনো যুক্তিনিষ্ঠ ভিত্তি নেই। যতদিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও সমাজ চরিত্র গুণগতভাবে না পাল্টাবে ততদিন নারীর উল্লিখিত লাঞ্ছনা দূর হবে না। দূর হবে না কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এখনো সংঘটিত পুলিশি নির্যাতন এবং তদসূত্রে বিচার বিভাগীয় অনাচার। উদাহরণ অনেক। বিষয়টি একান্তভাবেই আদর্শিক।

ইতোমধ্যে স্ট্যাচু অব লিবার্টির গা ঘেঁষে মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রত্যাশার জল গড়াতে থাকবে। বিশ্বজুড়ে ঢাকঢোল পেটানো হবে মার্কিনি গণতন্ত্রের মহিমাকীর্তনে। সমালোচকরা লিখতে থাকবেন যুক্তি তথ্যের সমাহারে ঋদ্ধ রচনাদি। ফলাফল একমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব, অন্য কোনো পথে নয়। ততদিন ক্রিস্টিনা ফোর্ডদের মর্মবেদনা লালন করতেই হবে। সুবিচার দূরে থাক বিচারপতিদের অবিচারের বিচার হবে না।

আহমদ রফিক : ভাষা সংগ্রামী, কবি ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App