×

মুক্তচিন্তা

সমাজ, সাহিত্য ও অর্থনীতি ভাবনা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:৫৪ পিএম

সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ গঠনের সম্পর্কও নিবিড়। বাস্তব সমাজের ভঙ্গিমার বিশ্বস্ত প্রতিফলনে আবার সেই বাস্তবসমাজকে সমালোচনার মাধ্যমে সমাজ বদলানোর প্রয়াসের মধ্যে সাহিত্যের সমাজগঠনের অভিপ্রায় ফুটে ওঠে। এই দ্বিমুখী উদ্দেশ্যময়তা কখনো সমান্তরালভাবে কখনো পরস্পর প্রবিষ্টতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্যকর্মী সমাজে হস্তক্ষেপ করেন পরস্পর প্রবিষ্টতার পথেই।

তিনের মধ্যে সম্পর্কটা সুপ্রাচীন, তবে সময়ের বিবর্তনে সম্পর্কের মধ্যে মতান্তর ঘটেছে। হতেই পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা সমাজ পরিবর্তনশীল নিজস্ব গতিতে, অর্থনীতি সমাজের সেই গতিশীলতার নিয়ামক আর সাহিত্যে সেই সমাজের প্রতিফলন ঘটবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় তখন যখন সাহিত্যের কিংবা অর্থনীতির কাছে সমাজ পরিবর্তনের প্রেসক্রিপশন প্রত্যাশা করা হয়, যখন আশা করা হয় সমাজ বিনির্মাণে আদর্শ ও দর্শন সরবরাহ করতে অর্থনীতি ও সাহিত্য সত্যিই কিছু করতে পারে কিনা। তা যদি না পারে তাহলে সাহিত্যের ভূমিকা নিয়ে নিদেনপক্ষে পক্ষপাতিত্বের অথবা অভাজনের অভিযোগ আনা যেতে পারে। আবার অর্থনীতি যদি সমাজের সমৃদ্ধি সাধনে লাগসই ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বঞ্চনা বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। সাহিত্য, তা কি কেবল প্রতিফলক সমাজের? তার কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই সমাজের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের? স্রেফ রেকর্ডেড হিস্ট্রি হয়ে কি লাভ সাহিত্যের? সে যদি প্রশ্ন উত্থাপনই না করতে পারল সমাজের গতিধারা নিয়ে, সমাজের গন্তব্য নিয়ে, সমাজের সার্থকতা নিয়ে তাহলে সাহিত্যের জন্মই যেন বৃথা। সমাজ সমাজের মতো এগুবে আর সুবোধ বালকের মতো সাহিত্য তা তুলে ধরবে নিখুঁত অবয়বে এই যদি হয় রীতিনীতি পথ চলার তাহলে সাহিত্যের যেমন থাকতে নেই নতুনত্বের কোনো পরিচয় পার্বণের আর সমাজেরও কোনো চিন্তাভাবনা থাকে না স্বেচ্ছাচারী হয়ে চলাচলের। অর্থনীতি বেকুব বনে যায় যে সমাজে, সেখানে সাহিত্যকে সমাজ কতটা ধার ধারবে বা সমীহ করে চলবে সে ব্যাপারে কোনো গাইড লাইন বা রোডম্যাপ এখন কেন কস্মিনকালেও কেউ দিতে পারেনি, পারবে বলে মনে হয় না। কখনো-সখনো এ ব্যাপারে কথাবার্তা যে ওঠেনি তা নয়, কিন্তু কার্যকারণগত কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যার অবর্তমানে আলোচনাটা যেন সেভাবে রয়েই গেছে।

নিঃসন্দেহে সমাজ আগে সাহিত্য ও অর্থনীতি অনেক পরে। সমাজ একটা বড় ব্যাপার অর্থনীতি ও সাহিত্য সেখানে অনুগামী একটা শরিকমাত্র। সাহিত্য সমাজকে আমলে না আনলে সমাজের কিছু একটা যায় আসে না, কিন্তু সাহিত্য সমাজকে উপেক্ষা করতে পারে না। সমাজই হচ্ছে সাহিত্যের ক্যানভাস, সমাজ ছাড়া সাহিত্যের চলে না, সমাজ আছে বলে সাহিত্যের কাজ আছে। সমাজ নেই তো শুধু সাহিত্য কেন অনেক কিছুই নেই। তবে সাহিত্য সমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেই সমাজ তার অস্তিত্ব, গতিধারা এমনকি মিশন ও ভিশন নির্মাণের জন্য অর্থনীতি ও সাহিত্যের পথ চেয়ে থাকে। সমাজ এগুচ্ছে না পেছাচ্ছে তা অর্থনীতি ও সাহিত্যের চেয়ে আর কে ভালো বলতে পারে? সমাজ সীমাহীন তীর হারা নদীর মতো চলার পথে সাহিত্য তার তীর বেঁধে দেয়, অর্থনীতি তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় নির্দেশ করে, গতিশীল হতে শলাপরামর্শ প্রেরণা দেয়। সমাজ যেন সার্থকতা ফিরে পায় সাহিত্যের মূল্যায়নে। সাহিত্য সমাজকে আর্কাইভে ভরে রাখে, তাকে শ্রেণিবিন্যাস থেকে শুরু করে পর্যায় পর্ব পরিচিতি পর্যন্ত নির্মাণ নির্ধারণের কাজও করে। সাহিত্য না থাকলে সমাজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু হতে পারত না, কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর তার থাকতো না। চর্যাপদের মধ্যে অঙ্কিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার সমাজচিত্র যেমন সমকালীন জীবনযাত্রার ইতিহাসের সংরক্ষক।

সমাজ চলে সমাজের সবাইকে নিয়ে, তাদের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা আদর্শ ও দর্শনকে অবলম্বন করে। সাহিত্যে এসব প্রতিফলিত হয়। এসবের ব্যত্যয় এর ব্যারোমিটার মনিটর করে অর্থনীতি। সমাজের গতি যুগধর্মকে অবলম্বন করে। পরিবেশ পরিস্থিতি যুগধর্মের নিশান বরদার। পরিবেশ আপনাআপনি নির্মিত হয় না। এর পেছনে কাজ করে নানান কার্যকারণ আর সেই কার্যকারণ সৃজিত হয় প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাত্রা ও মর্জির দ্বারা এবং প্রকৃতির আচরণের বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সূত্রে। মানুষ প্রকৃতির কোলে প্রতিপালিত হয়, প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মানুষ জীবনযাপনই শুধু করে না, সেই জীবনের নানান প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে, সহায়সম্পদ সৌধ নির্মাণ করে, রুচি-অভিরুচির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়ায় বেড়ে ওঠে মানব জীবনের নানান পর্ব। পার্ল এস বাকের গুড আর্থ এ আমরা জীবন আর প্রকৃতির নিরন্তর সংগ্রাম সৌহার্দ্যরে যোজনা দেখি। প্রায় শতবর্ষের কালপরিক্রমার ক্যানভাসে আনন্দ বেদনার কাব্য রচিত হয় চীনা সমাজে তিন পুরুষের সংগ্রাম আর সন্ধির আয়নায় দেখা অসংখ্য ঘটনা ও এর আকর্ষণ-বিকর্ষণের বর্ণিল অবয়বে। এখানে নিরন্তর রূপান্তর প্রত্যক্ষ করি উপলব্ধির, মূল্যবোধের, আচার-আচরণের। যুগধর্মের প্রতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন আচারণে নিষ্ঠ হয়েছে এর বিভিন্ন চরিত্র। সমকালীন সমাজের রূপান্তর আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয় চরিত্রনিচয়ের আবেগ-অনুভূতি আর উক্তি ও উপলব্ধির সালতামামির মাধ্যমে। অর্থনীতির প্রযোজনায় নগরায়ন ও শিল্পবিপ্লব এসেছে, গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে অনুপ্রবেশের অন্তরালে স্মৃতিভা-ারে যে দোলাচাল সৃষ্টি হয়েছে, চেতনার কার্নিশে জল পড়ে পাতা নড়ের যে অনুরণর সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে পাঠক উপলব্ধি করে নস্টালজিক নান্দনিকতার। শরৎচন্দ্রের দেবদাস-এ তাল সোনাপুর গ্রামে পার্বতী দেবদাসের আবাল্য কৈশোর ও বয়ঃসন্ধির আবেগ-উৎকণ্ঠাকে শহুরে চুনিলাল চন্দ্রমুখীর দগ্ধ জীবনবোধের সঙ্গে কালান্তরে এক অভিনব সমান্তরাল রৈখিক চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে জীবনের সেই নিত্যতাকে নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন লেখক যা মানব জীবনের শাশ্বত সম্পর্কের কাব্যগাথা। তাল সোনাপুর গ্রাম বাংলার হাজার গ্রামের একটি কিন্তু দেবদাস পার্বতীর গ্রাম হিসেবে তা হয়েছে স্বনামধন্য। সাহিত্য এভাবে সমাজকে কালান্তরে পৌঁছিয়ে দেয়। নগর আর গ্রামীণ জীবনের ক্যানভাসে পরিবর্তনের প্রান্তঃসীমায় মানব সম্পর্কের আটপৌরে অবয়ব, আনন্দ বেদনার, অভিমান আক্ষেপের, আভিজাত্য আর আবহমান হৃদবন্ধন প্রয়াসের ধ্রুপদ সঙ্গীত এখানে শ্রুত হয়।

লিও টলস্টয়ের আনা কারেনিনার চরিত্রগুলো রাশিয়ার সমকালীন সমাজ জীবনে আবহমান আভিজাত্যবোধের ক্যানভাসে মানব মানবীর শাশ্বত সম্পর্কের সংশয় সন্দেহের সখ্যের সর্বনাশের আখ্যান ফুটে উঠেছে। ক্ষয়িষ্ণু আর উঠতি সমাজের দ্বন্দ্ব ও মেলবন্ধনের কাব্যিক বর্ণনায় লেখক টলস্টয় প্রকারান্তরে সামন্তবাদী সমাজজীবনের নেতিবাচক ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যসমূহ এমনভাবে তুলে ধরেছেন সমাজ দর্শন-বিবর্তনের এক বিস্তারিক বৈশ্বিক পাঠ তাতে প্রতিভাত হয়েছে। শেকসপিয়রের সেনাপতি, রাজা, যুবরাজ, প্রেমিক, ভাড়, এমনকি কূটবুদ্ধির চরিত্রগুলো হরহামেশা সমাজদর্শনের কথা বলে চলে, তাতে যুগ যুগান্তের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার নির্যাস বেরিয়ে আসে, নিছক মনোরঞ্জনের জন্য নয় সমাজকাঠামোর মধ্যকার সবল ও দুর্বল দিকগুলোকে শনাক্তকরণের উদ্দেশ্য সেখানে অগোচর থাকে না। দস্তয়ভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট-এর কুশীলবরা সমাজের ন্যায়-অন্যায়ের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতীক পীড়ায় ভোগে, প্রশ্ন তোলে কারণ ও প্রতিক্রিয়ার আনুভূমিক সম্পর্ক ও তার চৌহদ্দি সম্পর্কে। কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা কিংবা হাসান আজিজুল হকের জীবন ঘসে আগুন-এর গল্পগুলো জীবনের যে উপলব্ধির আখ্যান নির্মাণে নিবেদিত তাতো ঘুণে ধরা সমাজের পরিবর্তন প্রয়াসের প্রতিচ্ছবি।

সাহিত্যের সঙ্গে সমাজ গঠনের সম্পর্কও নিবিড়। বাস্তব সমাজের ভঙ্গিমার বিশ্বস্ত প্রতিফলনে আবার সেই বাস্তবসমাজকে সমালোচনার মাধ্যমে সমাজ বদলানোর প্রয়াসের মধ্যে সাহিত্যের সমাজগঠনের অভিপ্রায় ফুটে ওঠে। এই দ্বিমুখী উদ্দেশ্যময়তা কখনো সমান্তরালভাবে কখনো পরস্পর প্রবিষ্টতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্যকর্মী সমাজে হস্তক্ষেপ করেন পরস্পর প্রবিষ্টতার পথেই। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল, শরৎচন্দ্র এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তারা তাদের বলয়ে থেকে সমাজে হস্তক্ষেপ করেছেন নানান অবয়বে। সাহিত্যে হস্তক্ষেপের মধ্যে সমাজ গঠনের ক্রিয়াশীলতা এবং পরিবর্ধনশীলতার প্রতি একটা সচেতন নিয়ন্ত্রণ প্রবণতা কাজ করে বলেই এর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্তাও অনায়াসে এসে যায়। বরং বলা যায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সাহিত্যকর্মীকে তার বক্তব্যের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতাকে প্রাণিত করে। আধুনিক সমাজবাদী রাশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (২২ এপ্রিল ১৮৭০-২১ জানুয়ারি ১৯২৪) জার্মান ভাবুক, দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তা কার্ল হাইনরিখ মার্কস (৫ মে ১৮১৮-মার্চ ১৪, ১৮৮৩)-এর রাজনৈতিক দর্শনকে তার সমাজভাবনার বলয়ে বিশেষভাবে আসন দিয়েছিলেন, সাহিত্যের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল এই মার্কসীয় সমাজদর্শন নানান বাকপ্রতিমায় সামন্তবাদ থেকে সমাজবাদী রাশিয়ায় উত্তরণে ভাবগত অনুপ্রেরণাদায়ী হয়ে উঠুক। বাংলা সাহিত্যকর্মী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কসীয় রাজনৈতিক দর্শনকে তার উপন্যাস মালায় (পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবা রাত্রির কাব্য, জননী) স্পর্শ করার প্রয়াস পেয়েছেন, শুধু স্পর্শ নয়, সরাসরি উপস্থাপন করেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। মানিকের কাজে নিয়তিবাদ, অস্তিত্ববাদ, মনস্তত্ত্ব ও মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এমনভাবে প্রবিষ্ট হয়ে আছে যে তার চরিত্রগুলো, তা সমাজের যে শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করুক না কেন তারা সজ্ঞান মানসিকতায় সমাজ ও তার রীতিনীতির সমালোচক। নিজেরা সমাজ নিগৃহীত নিস্পিষ্ট হয়েই তারা বাক্সময়। কুবের আর হোসেন মিয়া, শশী ডাক্তার আর কুশুম, শ্যামা ও শীতল বিপ্রতীপ হয়েও সপ্রতীম সমাজপ্রাণতার প্রশ্নে। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মার্কস যেমন তার The Communist Manifesto (১৮৪৮)-এর প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বাক্যে তার দর্শনের সারবর্তায় বলেছিলেন : ‘The history of all hitherto existing society is the history class struggles’ মার্কসের যুক্তি ছিল : capitalism, like previous socioeconomic systems, will inevitably produce internal tensions which will lead to its destruction. Just as capitalism replaced feudalism, he believed socialism will, in its turn, replace capitalism, and lead to a stateless, classless society called pure communism. This would emerge after a transitional period called the “dictatorship of the proletariat”: a period sometimes referred to as the “workers state” or “workers democracy” লেনিন কিংবা মার্কস রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে, সমাজবাদী রাশিয়ার স্থপতি লেনিন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আর শ্রেণি সংগ্রামের প্রবক্তা সাহিত্যকর্মী হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সাহিত্য ও সমাজের শরিকানা সংক্রান্ত আলোচনায় একটা প্রবণতার মাত্রা নির্দেশক মাত্র। যুগে যুগে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব সাহিত্য ও সমাজের পরস্পর প্রবক্তার পথে অভিযাত্রিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অষ্টাদশ শতকে যোশেফ এডিশন এবং রিচার্ড স্টিল নামে দুই সাংবাদিক বন্ধু স্পেকটেটর নামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যেখানে তারা প্রতি সংখ্যায় সর্বোচ্চ ২৫০০ শব্দের রসাত্মক অথচ সমাজসচেতনতামূলক নিবন্ধ ছাপতেন। ১৭১২-১৩ সালে রচিত এই জাতীয় রচনার সংকলন যা Coverly Papers নামে খ্যাতি লাভ করে, সমাজ ও সাহিত্যের পরস্পর প্রযুক্ততার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ রচনাসমূহের লেখকরা The Spectator গ্রুপের সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। The Spectator-Gi stated goal wQj “to enliven morality with wit, and to temper wit with morality... to bring philosophy out of the closets and libraries, schools and colleges, to dwell in clubs and assemblies, at tea-tables and coffeehouses”. It recommended that its readers “consider it part of the tea-equipage” and not leave the house without reading it in the morning. One of its functions was to provide readers with educated, topical talking points, and advice in how to carry on conversations and social interactions in a polite manner. In keeping with the values of Enlightenment philosophies of their time, the authors of The Spectator promoted family, marriage, and courtesy. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলো থেকে তৎকালীন বাঙালি সমাজ জীবনের আচার-আচরণ ও সমাজের বাস্তবঘন পরিচয় পাওয়া যায়। হরিণ শিকার, নৌকা চালনা, চৈড়ারি তৈরি, কাড়া-নাকাড়া ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর-কনেকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা এসব রচনায় রয়েছে। দেখা যায় সে সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। সে সমাজে গরু ছিল গৃহপালিত পশু; মেয়েরা পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা এবং কানে কুন্তল পরত।

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা ঊনবিংশ শতকে বাঙালি সমাজ ভাবনায় নবচেতনার সূত্রপাত ঘটান, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যরা তাদের মুখপত্র শিখা কে কেন্দ্র করে পরিচালিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সমাজ সংস্কারের চেতনাদাত্রী হিসেবে কাজ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামতনু লাহিড়ী, খান বাহাদুর আহছানউল্লা সমাজ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাকে শনাক্ত করে পরিবর্তন প্রয়াসে নিবেদিত হয়েছিলেন। এরা কর্মক্ষেত্রে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমাজে পরিবর্তন প্রয়াসী ছিলেন। তারা লেখকও ছিলেন। লেখনীর মাধ্যমেও তারা সমাজ সংস্কারমূলক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটান। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, কবি আবদুল কাদির, আবুল ফজল এরা একাধারে লেখক, কর্মবীর এবং ভাবুক ছিলেন। তারা তাদের লেখায় যেমন, তেমন তাদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও সমাজ উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়ন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App