×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক মূল্যবোধের শুভ দিক জাগ্রত হোক

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:১৩ পিএম

মনে হয় না সমষ্টির মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের শুভ দিক জাগ্রত না হলে শুভ কোনো কিছুর সন্ধান আমরা পাব। আগে ভাবতে হবে আমাদের ব্যক্তি জীবনের কর্মসাধনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার কতটুকু সমন্বয় ঘটেছে। আমাদের ব্যক্তি জীবনের মাঝে যদি নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকে, দেখা যাবে সমষ্টির মধ্যেও নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে না।

আমরা নৈতিকতা নিয়ে যখন কথা বলি, তখন আমরা সমাজ সংসারের মানুষকে এটাই বুঝাতে চাই যে, আমরা দেশের মানুষের ভালো-মন্দের বিচার-বিবেচনা করে নিজের খেয়ে বনের পশু তাড়ানোর জন্য সংসারের মানুষকে শতকষ্ট স্বীকার করেও শুভ এবং অশুভের পার্থক্যটা বুঝিয়ে থাকি। এখানে আমরা বলতে তাদেরই বুঝানো হচ্ছে, যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক উচ্চ স্তরে অবস্থান করে মনে করেন তাদের দয়ার ওপর আমরা সাধারণ মানুষ কোনো মতে বেঁচে আছি। তাদের মধ্যে এক শ্রেণির লোক আছেন, যারা ঘুষ দুর্নীতিকে কোনো ধরনের অপরাধ বলেই মনে করেন না। ভাবটা এমন, এই শ্রেণির ভদ্রলোকরাই আমাদের বেঁচে থাকার পথকে যেন মসৃণ করেছেন। কিন্তু বাস্তব অবস্থার যদি আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাই, তাহলে দেখতে পাব আমরা সাধারণ মানুষের দল ক্রমাগত ভয়াল এক অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে আমরা সুদূরপ্রসারী আলোক রেখায় স্নাত হয়ে আলোকিত মানুষ হতে পারছি না। লোভই বলি আর স্বার্থের কথাই বলি অর্থাৎ যা-ই বলি না কেন, আমাদের সেই লোভ লালসার আগুন এতটাই পুড়িয়ে ছারখার করছে যে, যার জন্য আজ আমরা নিজের জ্ঞান গরিমা সততার ওজন কিছুরই সঠিক হিসাব-নিকাশ করতে পারছি না।

আমরা কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে প্রতিদিনের যেসব কাজকর্ম সম্পাদন করছি, সেই কাজকর্মের মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। নিজের কর্মের কিংবা জ্ঞানের ওজন আমরা বুঝি না বলেই, আজ একজন মানুষ শত লেখাপড়া করেও অসৎকর্ম অর্থাৎ চরম নোংরামি করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। যে কাজ একটা সমাজের অশিক্ষিত মানুষও করতে দ্বিধাবোধ করবে কিংবা বলা যায় যে কাজ করতে একটা অনাহারে থাকা মানুষও শত লোভে পড়ে করবে না, সেই কাজকর্ম আমাদের একশ্রেণির ভদ্রলোকরা করতে পিছপা হন না। প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের সবকিছু বদলে যাচ্ছে কেন? কেন আজ সমাজ সংসারে প্রতি কোনায় কোনায় এতটা পচন ধরেছে। এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজভাবে বিশ্লেষণ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে এ দেশের সাধারণ মানুষের দল এটা ভালো করে বুঝে যে, আমরা আজ এমন এক সময় অতিক্রম করে যাচ্ছি, যে সময়টাকে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলা যায়, আমরা দেশবাসী অদ্ভুত এক আঁধারের করতলে করতলগত হয়ে বসবাস করছি। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে অন্ধকার তার থাবা প্রসারিত করে যাচ্ছে। আজ যেন যার সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা নেই, সেই সর্বত্র কথা বলছে। তার কথাই যেন আমরা বেশি করে শুনতে বাধ্য হচ্ছি কিংবা আমাদের তার কথা শুনতে বাধ্য করা হচ্ছে। আজ যার কোনো কিছু দেখে বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই, সেই হচ্ছে সব জটিল প্রশ্নের বিচার-বিশ্লেষক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, অযোগ্য লোকের দেখানো কুৎসিত কোনো কিছুকে সুন্দর বলতে আমরা ব্যাকুল হয়ে থাকি। আরো ব্যাখ্যা করে বলা যায়, যার কিংবা যাদের কোনো কিছু বোঝানোর ক্ষমতা নেই, সেই রকম অজ্ঞানদের বোঝানো ব্যাখ্যাসমূহকে আমরা ধরে নিচ্ছি সঠিক আলোচিত বিচার-বিশ্লেষণ বলে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে অদ্ভুত আঁধার, সেই অদ্ভুত আঁধারে আমরা কি ডুবে আছি। এই নির্মম অদ্ভুত আঁধার থেকে বের হওয়ার কোনো আলোকিত পথ আমাদের সামনে কি খোলা নেই। আবার এমন প্রশ্নও আসতে পারে আমাদের চোখ কান খোলা থাকতে আমরা কেন কবি জীবনানন্দ দাশের বলা অদ্ভুত আঁধারে ডুবে আছি। তারও যথার্থ উত্তর আছে। আর উত্তরটা হলো আমরা আত্মঘাতী। আমরা অলস এবং ভীতু। আমরা মেঘের বিদ্যুৎ রেখার মতো জ্বলে উঠে আবার নিভে যাই। তারপর বিশ্রী এক অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকি। আমার কথার অনেকই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। বলতে পারেন আমরা ভীতু কিংবা অলস হব কেন? কিংবা বলতে পারেন আমরা জ্বলে উঠে আবার মেঘের বিদ্যুৎ রেখার মতো নিভে যাব কেন। কেউ কেউ এমন কথাও বলতে পারেন আমরাই তো ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আবার সেই ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এই দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছি। ভীতুরা কিংবা অলসরা কিংবা আত্মঘাতীরা কি আন্দোলন-সংগ্রামের স্বপ্ন দেখতে পারে?

একাত্তরের সেই স্বপ্ন কিংবা চেতনা থেকেই আমরা যা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলাম, আমরা তো আমাদের চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছি কিংবা এখনো দেখতে পাচ্ছি একশ্রেণির লোভী মানুষের দল অর্থাৎ জোটবদ্ধ আত্মস্বার্থবাদীরা আমাদের সব অর্জনকে ছিনিয়ে কিংবা গ্রাস করে এখনো নিচ্ছে। আমরা যারা দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী, তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব, আমাদের সচেতন জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ সাময়িক লাভ-লোকসান কিংবা লোভের তাড়নায় নষ্ট মানুষের ছলচাতুরীর ফাঁদে কি পা দেয়নি। এখানে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা সচেতনভাবে কেন নষ্ট মানুষের ছলচাতুরীর ফাঁদে সাময়িক লাভ-লোকসান কিংবা হীনস্বার্থ উদ্ধারের ব্যাকুলতায় পা দিয়ে থাকি। এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ হচ্ছে চরম সুযোগ সন্ধানী। কেবলই চিন্তা করে মানুষকে সুযোগ পেলে কীভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা যায়। সে কম পয়সা আয় করুক কিংবা বেশি পয়সা আয় করুক না কেন, এটা কোনো ব্যাপার নয়। উদাহরণ দেয়া যায়, হয়তো দেখা গেল বাজারে কোনো জিনিসের অভাব দেখা দিল, হয়তো একটি মাত্র দোকানে সেই জিনিসটি আছে। তখন দেখা যাবে যার কাছে সেই পণ্যটি আছে, সে সঙ্গে সঙ্গে সেই পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার হয়তো দেখা গেল কোথাও শ্রমিকরা বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, কিছুতেই বড় গাড়িগুলো চলতে পারছে না। তখন দেখা যাবে ছোট ছোট যানবাহনে ড্রাইভাররা সুযোগ পেয়ে ৪০ টাকার ভাড়া ৮০ টাকা করে নিচ্ছে। অর্থাৎ সবাই সুযোগ সন্ধানে থাকে বলেই ভালো মন্দের বিচার না করে সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে থাকে। অচেতন মানুষ জানেই না কখন সে নিজের অজান্তে নিজের বিরুদ্ধে চলে যায়। অভিজ্ঞজনরা অনেকবার মাঠে ঘাটে পত্রিকার পাতায় এসব কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা এমন এক অবস্থানে বসবাস করছি, যেখানে ভালো কথা বারবার বললেও আমাদের ঘুম ভাঙে না। লেখার প্রথমে নৈতিকতার কথা বলেছিলাম। নৈতিকতা কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের কথা আমরা যাই বলি না কেন, আমাদের আগে ভাবতে হবে আমরা যে পথ ধরে হাঁটছি সেই পথের কথার সঙ্গে আমাদের নৈতিক জীবনের মিল কতটুকু আছে। নৈতিকতা নিয়ে একজন ব্যক্তি তখনই জোর গলায় কথা বলতে পারেন যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের কর্ম এবং নৈতিকতার মাঝে সমন্বয় ঘটিয়ে সুন্দরের মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন।

আমরা ঘর পোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। ঘর ছেড়ে বাঁচার জন্য যতই নৈতিকতা কিংবা সামাজিক শুভ মূল্যবোধ নিয়ে চিৎকার করে কথা বলি না কেন, মনে হয় না সমষ্টির মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের শুভ দিক জাগ্রত না হলে শুভ কোনো কিছুর সন্ধান আমরা পাব। আগে ভাবতে হবে আমাদের ব্যক্তি জীবনের কর্মসাধনের ক্ষেত্রে নৈতিকতার কতটুকু সমন্বয় ঘটেছে। আমাদের ব্যক্তি জীবনের মাঝে যদি নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা না থাকে, দেখা যাবে সমষ্টির মধ্যেও নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে না। শেষে এ কথাই বলতে চাই, আমাদের নৈতিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের ভাবতে হবে নৈতিকতা কিংবা সামাজিক মূল্যবোধটুকু নিজেদের মধ্যে আমরা কি ধারণ করে থাকি। শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : আইনজীবী ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App