×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, ফাদার মারিনো রিগন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:২৫ পিএম

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর দশজন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো তিনি যুদ্ধপীড়িত সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কৃষিজীবী রিকার্ডো রিগন আর শিক্ষিকা ইতালিয়া মনিকা রিগনের আট সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ মারিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিন্নাভের্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি তাঁর বাবা গ্রামের নাট্য দলে অভিনয় ও গানবাজনা করতেন। একটি মঞ্চ নাটকে যিশুর চরিত্রে বাবাকে অভিনয় করতে দেখে মাত্র ৬ বছর বয়সে মারিনো রিগন স্বপ্ন দেখেন পুরোহিত হওয়ার। ১৯৩১ সালে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে যোগ দেন ক্যাথলিক মিশনারিতে। মিশনারির তত্ত্বাবধানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের পড়া শেষে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ধর্ম প্রচারক হিসেবে অভিবাসী হওয়ার ইচ্ছায় তিনি গ্রিক, ফরাসি, লাতিন ও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন। তারপর ২৮ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে ধর্ম প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েন তিনি।

মানব সেবায় নিবেদিত খ্রিস্ট যাজক ফাদার মারিনো রিগন ১৯৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের কলকাতায় পৌঁছেন এবং সেখান থেকে ট্রেনে করে ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসেন। কর্মসূত্রে তিনি বাংলাদেশের নানা অঞ্চল ঘুরে অবশেষে সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন এবং বাংলাদেশকে আপন করে নেন। জীবনের অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে অতিবাহিত করার ফলে এ দেশ ও এ দেশের মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মায়া জন্মে। আর এ দেশের মাটি ও মানুষের মায়ার টানে তিনি বাংলার মাটিতে সমাহিত হওয়ার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

নানাগুণে গুণান্বিত মানুষটি ছিলেন একাধারে সমাজসেবক, কারুশিল্পী, উদ্যোক্তা, শিক্ষাব্রতী, স্থাপত্যশিল্পী ও লেখক। এক কথায় অসাধারণ এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

দীর্ঘদিন এ দেশে বসবাসের কারণে কাজের সুবিধার্থে বাংলা ভাষা শিখতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে তিনি এ দেশের সাহিত্যের প্রেমে পড়েন গভীরভাবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য দিয়েই তাঁর বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ। অতঃপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন এবং পড়তে থাকেন রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক রচনাবলি। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাস যতই পড়েন ততই তাঁর ভালো লাগে। আর যত ভালো লাগে ততই তিনি আরো আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকেন। এই ভালো লাগা থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর নিবিড় ভালোবাসা জন্ম নেয়। এভাবেই রবীন্দ্র জীবনদর্শনে তিনি আপ্লুত, প্রাণিত ও মুগ্ধ হন। বাংলার চারণ দার্শনিক লালন সাঁইয়ের প্রতিও তিনি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। লালন সাঁইয়ের জীবন ভাবনার মধ্যে তিনি নিজেকে নিবিষ্ট করেন।

তিনি ইতালিয়ান ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, জসীম উদ্দীনের নকশিকাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অসংখ্য কবিতা অনুবাদ করেছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। তা ছাড়াও তিনি ইতালীয় নন্দিত কবি কার্লো কল্লোদির রূপকথা পিনোকিও বাংলায় অনুবাদ করেন এবং এর নাম দেন কাঠের মানুষ পিনোকিও। তিনি বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন। তার মধ্যে আমার প্রিয় লালন গীতি, আমার গ্রাম, অস্তগামী সূর্য, ভিন্নাভের্লা থেকে শেলাবুনিয়া, মাথায় লালন হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও নারী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা আবৃত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে শোনান। তিনি ফরাসি, স্পেনিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি ইতালিতে রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৮২ সালে কবি জসীম উদ্দীন অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তা ছাড়া শিল্প ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দেশে-বিদেশে বহুসংখ্যক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ফাদার মারিনোর সেবামূলক কাজের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থাও করেন তিনি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মানবতাকেই অস্ত্র হিসেবে নিয়েছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাদার মারিনো রিগন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্মযাজক ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর দশজন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো তিনি যুদ্ধপীড়িত সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য গোপনে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি তাঁর মিশন ও ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও চিকিৎসা প্রদান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করা হয়।

তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল। তিনি ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত স্মারক সংগ্রহ অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি ও মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন কাজে সহায়তা করার জন্য ৪টি নৌকা তৈরি করে এগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘সংগ্রামী বাংলা’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ‘স্বাধীন বাংলা’ ও ‘মুক্ত বাংলা’। এই নৌকাগুলোও তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দান করেন। মানবসেবা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। তা ছাড়াও তিনি দেশে-বিদেশে বহুসংখ্যক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

ফাদার মারিনো রিগন ২০০১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ইতালি নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তাঁর স্বজনদের শর্ত দেন যে, ইতালিতে মৃত্যু হলে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। তিনি বাংলাদেশকে নিজ জন্মভূমি হিসেবে ভাবতেন। তাই বাংলাদেশের মাটিতে তিনি চিরনিদ্রায় ঘুমাতে চেয়েছিলেন। একজন বিদেশি হয়েও বাংলাদেশর প্রতি তাঁর এই টান সত্যিই অতুলনীয়। পরবর্তীকালে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ধর্মগুরুদের নির্দেশে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালে ইতালিতে গমন করেন। চিরকুমার এই মহান পুরুষ ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ইতালির ভিচেনজায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল তিনি বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর দ্বারা স্থাপিত শেলাবুনিয়া চার্চের পাশের্^ শায়িত হবেন। তাঁর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে গত ২১ অক্টোবর সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁর মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনয়ন করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাগেরহাটে তাঁর দ্বারা স্থাপিত শেলাবুনিয়া চার্চের পার্শ্বের সমাধিস্থ করা হয়।

লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির : বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App