×

মুক্তচিন্তা

সরকার কি খুব বিচলিত?

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:২১ পিএম

ঐক্যফ্রন্ট যদি সত্যি সরকারবিরোধী সব শক্তিকে এক ছাতার নিচে আনতে পারত তাহলে একটা ‘নড়াচড়া’ হলেও হতে পারত। কিন্তু দলছুট, দল বদলকারী, সুবিধাবাদী এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে যে ঐক্যফ্রন্ট সেটা মানুষকে কতটুকু আন্দোলিত করতে পেরছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কামাল হোসেন নেতৃত্ব দিতে অতীতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবার বিএনপির হাত ধরে সফল হবেন তা কি আশা করা যায়?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে দুই মাসের কিছু বেশি সময়। কিন্তু নির্বাচন হওয়া না-হওয়া নিয়ে কারো কারো মনে কিছু সংশয় এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘নির্বাচন সত্যি হবে কি’- এই প্রশ্ন যারা করছেন তারা কিসের আশা বা আশঙ্কায় এটা করছেন, জানি না। নির্বাচন না হলে কি হবে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা কীভাবে অক্ষুণ্ণ থাকবে- সংশয়বাদীদের কাছে এসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব নেই।

নির্বাচন নিয়ে সংশয়-সন্দেহের গুজব ছড়ানো হচ্ছে মূলত বিএনপি এবং তাদের সমর্থকদের পক্ষ থেকেই। বিএনপি একটি অদ্ভুত রাজনৈতিক অবস্থানে আছে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, নিজেরা ক্ষমতায় যেতে চায়। তাদের এই চাওয়ায় দোষের কিছু নেই। যে কোনো রাজনৈতিক দলেরই তো লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। বিএনপি তো আর যেমন তেমন দল নয়। এই দলের জন্ম হয়েছে ক্ষমতার জঠরে। তারপর ভোটে নির্বাচিত হয়েও তারা একাধিকবার ক্ষমতায় গেছে। এখন এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে আছে। এটা তাদের জন্য চরম অস্বস্তিকর। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি এখন মরিয়া।

ক্ষমতায় যেতে হলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিদায় জানাতে হলে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন একেবারে দুয়ারে হাজির হলেও বিএনপির এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। নিজেদের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থা তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় আছে তারা। বিএনপির অনেক দাবিদাওয়া আছে। আগে তাদের প্রধান দাবি ছিল সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি এবং সেটা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই। এই দুটি দাবিই আদায়যোগ্য বলে মনে হয় না। সাংবিধানিকভাবেই আর ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। আবার খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিও আদালতের এখতিয়ারের বিষয়। মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, এই দুই দাবি আদায় না হলে কি বিএনপি নির্বাচনে যাবে না? বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকার বা আওয়ামী লীগের কি বিশেষ কিছু আকুলতা বা কাতরতা আছে? অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকই বিএনপির ইচ্ছা পূরণের সম্ভাবনা দেখেন না। তবে বিএনপি মহল থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটি অপচেষ্টা আছে।

বিএনপি ছাড়াও আরো কিছু দল এবং ব্যক্তিও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের শক্তি-সামর্থ্য কম। তারা এখন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে খুশিতে বগল বাজাতে শুরু করেছে। তাদের ধারণা কামাল হোসেনের সুনাম, খ্যাতি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তাদের ক্ষমতার কাছাকাছি নিতে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। সাবেক বিএনপি নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকেও এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল করা হয়েছিল। কিন্তু ঘোরাঘুরির পর ডা. বি চৌধুরী ছিটকে পড়েছেন। সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন। বিএনপি মনে করছে, ঐক্যফ্রন্টের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে তারা বিপদ মুক্তির পথ পাবে। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে বলে যারা মনে করছেন তারা খুব সুবুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছেন এমনটা বলা যাবে না।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তারা দ্রুত দেশে একটি বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। যদিও রাজনৈতিক বাস্তবতা, জনগণের মনোভাব কোনোটাই আন্দোলনের অনুকূল বলে মনে হয় না। বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে সরকারের বাঁধ ভাঙতে হবে। মাঠে নামতে হবে’। মওদুদ আহমদ স্পষ্ট করেননি যে, কীভাবে সরকারের বাঁধ ভাঙবেন! সেটা কি ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও’ রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে, নাকি তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে? বাস্তবে দুটোর একটিও হওয়া সম্ভব নয়।

মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে সরকারকে আমরা বিচলিত দেখতে পাচ্ছি। বিভিন্ন রকমের বক্তব্য দিয়ে তারা এটাই প্রমাণ করছে যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে তারা ভয় পায়। জাতীয় ঐক্যকে ভয় পায়, দেশের মানুষকে ভয় পায়’!

মওদুদ আহমদের এই বক্তব্য যদি সত্যের কাছেও হয়ে থাকে তাহলে তো তাদের আনন্দের সীমা থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকার কি সত্যি ঐক্যকে ভয় পাচ্ছে কিংবা বিচলিত বোধ করছে? যারা ছোট বিষয়কে বড় করে দেখার রোগে ভুগছেন, তারা ঐক্যফ্রন্টকে যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন, দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী সেভাবে দেখছেন বলে মনে হয় না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আবেগ তাড়িত হয়ে চলেন না, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে চলেন।

ঐক্যফ্রন্ট যদি সত্যি সরকারবিরোধী সব শক্তিকে এক ছাতার নিচে আনতে পারত তাহলে একটা ‘নড়াচড়া’ হলেও হতে পারত। কিন্তু দলছুট, দল বদলকারী, সুবিধাবাদী এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে যে ঐক্যফ্রন্ট সেটা মানুষকে কতটুকু আন্দোলিত করতে পেরছে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কামাল হোসেন নেতৃত্ব দিতে অতীতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবার বিএনপির হাত ধরে সফল হবেন তা কি আশা করা যায়? সর্বশক্তি নিয়োগ করেও আন্দোলনে সফল হতে পারেনি। ০ + ০ সমান যদি ০ হয়, তাহলে ব্যর্থ + ব্যর্থ সমান কি হবে?

সরকার তথা আওয়ামী লীগ সবদিক বিবেচনাতেই এখনো সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের গোড়াতেই গলদ। শুরুটাই তারা করেছে বিদেশিদের দিয়ে। জনগণের কাছে না গিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গেছে বিদেশিদের কাছে। জনগণের আস্থার তাদের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। কেউ এখন আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে নেই। জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছে। নির্বাচনমুখী জনগণকে ১০/২০ দিনে আন্দোলনমুখী করা সম্ভব না’।

এ ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদের খুব ভুল কথা বলেছেন বলে মনে হয় না। জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দিলে তাতে জনগণের সমর্থন পাওয়ার আশা কম। তাছাড়া নির্বাচন গায়ে লাগিয়ে আন্দোলন করাও সহজ কাজ নয়। গণআন্দোলন কোনো জাদুমন্ত্রের ব্যাপার নয়। কেউ চাইলেই বা কেউ ‘আন্দোলন হও’ বলে ছুঁ বললেই আন্দোলন হলে বিএনপির বর্তমান হাঁটু ভাঙা দ-য়ের অবস্থা হতো না। আকাক্সক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে একটা তফাৎ সব সময়ই থাকে। বিএনপি তথা সরকারবিরোধীরা সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে না চাইলেও সরকারকে ‘বিচলিত’ করার মতো কোনো কাজ তারা করতে পারেনি। নানা কারণে সংকটজর্জরিত বিএনপির উচিত আগে ঘর মেরামত করা। আঘাত করলে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা তো থাকবেই।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App