×

জাতীয়

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের কাছে দলগুলোর ধরনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১১:০২ এএম

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের কাছে দলগুলোর ধরনা
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরব কূটনৈতিক অঙ্গন। রাজনৈতিক নেতারা যেমন সমর্থন পাওয়ার আশায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার কূটনীতিকদের দুয়ারে নিয়মিত ধরনা দিচ্ছেন; তেমনি প্রভাবশালী বিদেশি ক‚টনীতিকরাও বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী পরিস্থিতির দিকে গভীর নজর রাখছেন। দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে তাদের অভিযোগ-অনুযোগ শুনছেন, পরার্মশ দিচ্ছেন। ক্ষেত্র বিশেষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকাও রাখছেন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও চীন, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কূটনীতিকরাই বেশি সক্রিয়। এমনকি জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও বসে নেই। তারাও নানাভাবে নসিহত করছে রাজনীতিকদের। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি ক‚টনীতিকদের এই তৎপরতা ভালো চোখে দেখছেন না অনেকেই। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোই উচিত নয় বলে মনে করেন তারা। কূটনীতিকরা অবশ্য বলছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ নয়; বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন তারা। বিদেশিদের সমর্থন পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি। শক্তিধর দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করে সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে। তাদের দাবির বিষয়ে অবহিত করছে। এমনকি সরকারের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য সহযোগিতাও চাইছে। তবে এর পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বসে নেই ক্ষমতাসীনরাও। সরকারি ও দলীয়ভাবে নিয়মিত কূটনীতিকদের ডেকে নিজেদের অবস্থান জানাচ্ছে তারা। নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তা-ভাবনার বিষয়ে বার্তা দিতে কূটনৈতিক অঙ্গনে জোর তৎপরতা চলছে সরকারের তরফ থেকে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। লক্ষ্য সফলে দলের শীর্ষ চার নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ চার নেতা হলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ। এ চার নেতাকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান, গত দুই মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন তারা। কখনো দূতাবাসগুলোয় যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা, কখনো ওই রাষ্ট্রদূতরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসায়-অফিসে আসছেন, কখনো তারকা হোটেলে চলছে দ্বিপক্ষীয় আলাপ। গত সোমবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলের ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনৈতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন ক্ষমসতাসীন দলের নেতারা। দলটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উপ-কমিটির আয়োজনে একটি রুদ্ধধার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় আগামী নির্বাচন ধরন ও পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চান কূটনৈতিকরা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ইসি নিশ্চয়ই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এর ৩ দিন পরই সেতু ভবনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন, ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারক খান ভোরের কাগজ বলেন, আমাদের বিশেষ কোনো কূটনৈতিক উইং নেই। বিএনপির মতো নালিশ জানানোরও প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, এখানে যেসব বিদেশি রাষ্ট্রদূত আছেন তাদের আর আমাদের ভাবনাগুলো সমন্বয় করার চেষ্টা করছি। তাদের সেই ভাবনায় যদি কোনো ঘাটতি থাকে, সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। মূলত দলের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতেই আমাদের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপ-কমিটিমূলক কাজ করছে, আপাতত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। কূটনৈতিক নেতারা এসে কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে না বলেও মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা। দলটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বলেন, দুই ধরনের ক‚টনীতিতে মনোযোগী আমরা। প্রথমটা হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বিশ্বে ক‚টনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে বিএনপি। কূটনৈতিদের সমর্থন আদায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর গত ৮স মাসে প্রায় ২ ডজনেরও বেশি বৈঠক করে কূটনৈতিকদের কাছে নালিশ জানিয়েছেন দলটির নেতার। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, খালেদা জিয়ার সাজা ও জামিন এবং আগামী নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দলের অবস্থান ও আকাক্সক্ষা কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরেছেন তারা। মিশন সফলে প্রকাশ্যে ও গোপনে একাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। ঢাকায় বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশনের সঙ্গে বিএনপির একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে ‘গোপন মিশন’ নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্রে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেখানে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সংস্থাটির রাজনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিরস্লাভ জেনকি, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার পাশাপাশি ১৮টি থিংক ট্যাংক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আসন্ন নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য সহযোগিতা চেয়ে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেছে বিএনপি। জবাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে অল-আউট সাপোর্ট পেয়েছে বলে দাবি করেছে দলটি। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে নানা তৎপরতার পাশাপাশি ভারত যাতে আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকে তা নিয়ে বিএনপি কাজ করেছে। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল কয়েক মাস আগে ভারত সফরও করে এসেছে। ওই সফরে বিএনপি কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী, ক্ষমতাসীন বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ সুশীলসমাজের কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। তবে ঐক্যফ্রন্ট্র গঠনের পর কূটনৈতিক মিশনে আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠছেন বিএনপি নেতারা। তাদের মতে ভোটের মাঠে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ অন্য নেতারা বড় নিয়ামক না হলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের একটা পরিচিতি আছে। ‘বৃহত্তর ঐক্য’ তৈরি হওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়ে তারা কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে পারবেন। সেই হিসেব মতেই গত ১৮ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীতে একটি হোটেল প্রায় ২৫টি দেশের ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। জোটের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন ফ্রন্টের সাত দফা ও ১১ দফা লক্ষ্য ক‚টনীতিকদের সামনে তুলে ধরেন। এরপর বর্তমান গণতন্ত্র, সরকার, নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপি সব সময় সব পরিস্থিতি বিশ্ব নেতাদের অবহিত করে। কারণ এই মুহূর্তে তাদের সমর্থন জরুরি। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা বলেছেন তারা বাংলাদেশে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে তারা বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনকে বুঝিয়েছেন। তাহলে দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। বহির্বিশ্ব চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তারা চায় শক্তিশালী গণতন্ত্র ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। এই চাওয়াগুলো তো বিএনপির পক্ষেই যায়। ক‚টনৈতিক সূত্র জানায়, বিচ্ছিন্নভাবে নানা ক‚টনৈতিক উদ্যোগ ও বৈঠকের মাধ্যমে সংলাপ আয়োজনের অব্যাহত চেষ্টা চালাচ্ছেন ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা। তাই বিবৃতি ও আহ্বানের মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরপরও সংলাপ বা সমঝোতা না হলে নভেম্বরের মাঝামাঝি সমন্বিত উদ্যোগের কথা ভাবছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও মিশন প্রধানরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে দিন দিন পরিস্থিতি ঘোলা হচ্ছে এ কারণেই সমন্বিত উদ্যোগের কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এটি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুসারে নভেম্বরের মাঝামাঝি পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হবে। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও যদি সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হয় তখনই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App