×

মুক্তচিন্তা

গণতন্ত্রে পা ধরা শোভনীয় নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:০৮ পিএম

যিনি মাথানত করছেন, তার ‘ইগো’ থাকছে না, তিনি বিনয়ী হচ্ছেন। আর যার পা ছোঁয়া হচ্ছে, তিনি আশীর্বাদ বা দোয়া করছেন, তার শুভানুধ্যায়ী হচ্ছেন। এই দুইজন একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা বোধ করেন এবং এদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে না বা কমে যায়? মোদ্দা কথা হচ্ছে, পা ছুঁয়ে সালাম বা প্রণাম করাটা খারাপ কিছু নয়, তবে রাজনীতিতে বিসদৃশ এবং গণতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য।

আমাদের দেশে রাজনীতিতে পা ছুঁয়ে সালাম করা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। আমরা হয়তো জানিই না যে গণতন্ত্রে পা ধরাটা অশোভন। তবে স্কুলের টিচার বা মুরব্বিদের সালাম করাটা বাঞ্ছনীয়। আমেরিকাতে পায়ে ধরে সালাম করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। কোথাও যেন বিজ্ঞাপন দেখেছি, ‘ফিট ডাজ নট ডিজার্ভ রেসপেক্ট’। আসলে ব্যাপারটি তো পা-কে সম্মান করা নয়, মানুষটিকে সম্মান করা। তবে রাজনীতিতে পা ধরাটা সম্মানসূচক নয় বরং অন্য কিছু। কিছু মানুষ যখন অন্যের পা ছুঁতে যান, তখন যার পা ছুঁতে যাওয়া হয় তিনি লজ্জিত হন? তা ছাড়া বয়সের একটু ব্যবধান লাগে, প্রায় সমবয়স্ক কেউ কারো পা ছুঁলে বিব্রত হতে হয় বৈকি? পা ছুঁয়ে সালাম বা প্রণাম করাটা সম্মানের, খারাপ নয়, কিন্তু রাজনীতিতে সম্ভবত সেটা অতিমাত্রায় ‘আনুগত্য’? ভারতের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে যতবার দেখা করেছি ততবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছি। আমার মনে আছে প্রথমবার যখন আমি দাদার বাড়িতে দেখা করতে যাই, তখন তিনি সম্ভবত প্রতিরক্ষামন্ত্রী। দেখা করলাম, অনেকক্ষণ তিনি সময় দিলেন। শুরু করেছিলাম নমস্কার দিয়ে। কথা শেষ করে উঠে আসার সময় বললাম, দাদা, আপনি ব্রাহ্মণ, বয়সে আমার বাবার সমান, আপনাকে কি প্রণাম করতে পারি? দাদা, রাজি হন। তারপর তিনি পররাষ্ট্র, অর্থ বা যে মন্ত্রীই হন না কেন, যখনই দেখা হয়েছে, প্রণাম করেছি। অন্যদেরও নিয়ে গেছি, সবাই প্রণাম করেছে। ২০১৪ সালে তিনি যখন রাষ্ট্রপতি, তখন তার প্রটোকল আগেই জানিয়ে দেয় যে, পা ধরে প্রণাম করা যাবে না। আমরা করিনি। পরে দাদা আমায় একা ডেকে পাঠালে জিজ্ঞাসা করি, এর কারণ কি? দাদা বললেন, রাষ্ট্রপতি পদটি সাংবিধানিক এবং গণতন্ত্রে পা ধরা শোভনীয় নয়। পা ধরে প্রণাম বা সালাম করা মূলত একটি ভারতীয় সংস্কৃতি। বয়সে বড়, গুরুজন বা ধর্মীয় গুরুদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করার শিক্ষা সেই ছোটকালেই দেয়া হয়ে থাকে। এটি মূলত সম্মান জানানোর একটি রীতি। বাবা-মা, দাদু-দিদিমা, শিক্ষক, পুরোহিত, বড়দের প্রণাম জানানো প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। প্রণাম (প্রো-আনাম) শব্দটি সংস্কৃত। ‘প্র’ অর্থাৎ সামনে, বা এগিয়ে। আনাম হচ্ছে, নত হওয়া বা ঝুঁকা। প্রণাম হচ্ছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে সামনের দিকে নত হওয়া। সাংস্কৃতিক অর্থে, প্রণাম হচ্ছে, সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন বা শ্রদ্ধা নিবেদন। যার পা ধরা হচ্ছে, তিনি সর্বদাই বয়সে বড় এবং শ্রদ্ধার পাত্র। উপমহাদেশে এটি শ্রদ্ধা জানানোর একটি সাধারণ নিয়ম। আগে যেহেতু যৌথ পরিবার ছিল, তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বা নতুন বৌ সব গুরুজনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করত। দূর-দূরান্তে যাত্রাকালে, বিয়ে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বড়দের পা ছুঁয়ে প্রণাম করাটা অতি স্বাভাবিক ছিল। কালের বৈচিত্র্যে পা ধরাটা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। ছোটরা যখন কারো পা ছুঁয়ে প্রণাম করে, তখন যাকে সালাম বা প্রণাম করা হয়, প্রত্যুত্তরে তিনি ছোটদের মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেন। আমাদের ছোটকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গুরুজনদের পা ধরে প্রণাম করলে দক্ষিণা পাওয়া যেত, তাতে প্রণাম করতে আমাদের কোনো কার্পণ্য ছিল না। বয়সে কিছু বড়রা তখন ঠাট্টা করে বলত, ‘আমাকে প্রণাম কর, আমি এক টাকা দিমু’। নো প্রবলেম? এই যে পা ছুঁয়ে প্রণাম বা সালাম, এর উৎপত্তি কোথা থেকে, কেন বা কখন, সেই সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। দেবতার সামনে প্রণাম ব্যতীত, এর ধর্মীয় যোগসূত্র কি তাও অজানা। তবে কেশব ম্যাথুর নামে এক ভারতীয়ের মতে, এর উপকারিতা বহুবিধ। যিনি মাথানত করছেন, তার ‘ইগো’ থাকছে না, তিনি বিনয়ী হচ্ছেন। আর যার পা ছোঁয়া হচ্ছে, তিনি আশীর্বাদ বা দোয়া করছেন, তার শুভানুধ্যায়ী হচ্ছেন। এই দুইজন একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা বোধ করেন এবং এদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে না বা কমে যায়? মোদ্দা কথা হচ্ছে, পা ছুঁয়ে সালাম বা প্রণাম করাটা খারাপ কিছু নয়, তবে রাজনীতিতে বিসদৃশ এবং গণতন্ত্রে অ-গ্রহণযোগ্য। নিউইয়র্ক থেকে ১৯ অক্টোবর ২০১৮ শিতাংশু গুহ: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App