×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হোক উত্তেজনা কাম্য নয়

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:১৬ পিএম

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার বিভিন্ন মানসিকতা ও দর্শন লালন করা ব্যক্তিরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় একই মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। যে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই পাকিস্তানি আদর্শপুষ্ট সুশীল ব্যক্তিরাও এই মঞ্চাভিনয়ে নেমেছেন দেখে বিস্মিত হতে হয়! এর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এবং স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বলে দাবি করা ব্যক্তিরা আছেন। সমাজের সচেতন ও সুশীল বলে এবং ন্যায়বান ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিষ্ঠিতরাও যুক্ত হয়েছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সবার মাঝে এক ধরনের নির্বাচনী আমেজ লক্ষ করা যাচ্ছে। অপরদিকে আবার এই নির্বাচনী আমেজের চেয়ে উত্তেজনাই বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো কোনো গোষ্ঠী বা মহলবিশেষের মধ্যে এই উত্তেজনা সৃষ্টির প্রবণতাও কম লক্ষ করা যাচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই উত্তেজনার মাত্রা রাজনৈতিক তো বটেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতা লাভের ষড়যন্ত্রও কিনা তাও তলিয়ে দেখার আবশ্যকতা আছে। বিভিন্ন দল ও জোটের নেতৃত্বদানকারী ও সমর্থনকারীদের মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার লালসা এখন তুঙ্গে। ক্ষমতার স্বর্ণশিখরে আরোহণের স্বপ্নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে চেতিয়ে চেতিয়ে উঠছে নির্বাচনী পরিবেশকে উত্তেজিত করার হিড়িক। তাদের মনের ভেতর চেতিয়ে-ওঠা এসব উত্তেজনা কিংবা উত্তেজনার রসদ দেখে দেখে সময়ে অসময়ে আমরাও দর্শক হিসেবে যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে পড়ি এবং ভুক্তভোগী হিসেবে ফলও ভোগ করি ক্ষেত্রবিশেষে। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উৎসাহব্যঞ্জক নির্বাচনী আমেজ তৈরি হোক, কোনো ধরনের উত্তেজনা নয়।

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে দিকে দিকে রণবাদ্যের দামামা বেজে উঠছে যেন! যে করেই হোক আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটাতেই হবে। বুকের ভেতর কার কতটুকু বিশ্বাস আছে জানি না তবে মুখে মুখে এমন প্রত্যয় স্বপ্নবাদী অনেক রাজনীতিবিদ এবং এককালীন সুশীলের ছদ্মবেশে থাকা বিশালদেহী ব্যক্তিদের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। এরই ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহসা মনে হয় নির্বাচনী আমেজ বিদূরিত হয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনাই বেশি সৃষ্টি হচ্ছে। আবার এও দেখা যায় যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু বেশকিছু নামি-বেনামি গোষ্ঠীর ‘ঐক্যরূপ’ এক ছাতার নিচে জমায়েত হওয়াকে গণমাধ্যমসমূহও আবার এমন বাতাসে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে নাড়িয়ে তুলছে যে তা যেন যে কোনো মুহূর্তেই আওয়ামী বিধ্বংসী টর্নেডোতে পরিণত হয়ে যাবে! এসব দেখে-শুনে একটি গ্রাম্য প্রবাদের কথা মনে পড়ে যায়- ‘খালি কলসি/বাজে বেশি’। শেষ পর্যন্ত শুরুতেই ডা. বি চৌধুরীকে ‘মাইনাস’ করে ড. কামাল হোসেন-মান্না গংয়ের জাদুকরি তেলেসমাতিতে এ দেশের ডান-বাম-পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ-উঁচু-নিচু প্রভৃতি নানা আদর্শের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা একত্র হয়েছেন। এদের মধ্যে পূর্বপুরুষানুক্রমে যেমন আছেন একদা আওয়ামীভক্ত এবং পরে আওয়ামী-বিদ্বেষী আবার বিএনপি নন কিন্তু বিএনপির তল্পিবাহক গোষ্ঠীও। আছেন নামকরা বাম, নামকরা ডানও। তারা সবাই মিলে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ধনুর্ভঙ্গপণ করে জোটবদ্ধ হয়েছেন! জোটবদ্ধ এসব ব্যক্তির রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রাচীন ইতিহাস অনেকেরই অনেক রকমের- ‘একই অঙ্গে এত রূপ মার্কা’! তবু রাজনৈতিক স্কুলিং-অনুযায়ী একেকজন একেক রকমের হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের গণমাধ্যম তাদের সেই শূন্যগর্ভ হুঙ্কারকে শতগুণ মিডিয়া কভারেজ দিয়ে প্রকাশ করছে। তাতেও উত্তেজনা কিছুটা বাড়ছে।

আজ যারা ডান-বাম-পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের নানা বর্ণ-গন্ধ-গানের ‘কথাশিল্পীরা’ একই ছাতার নিচে জমায়েত তথা ঐক্যবদ্ধ তাদের কারো কারো ব্যক্তিত্ব নানা কারণে উজ্জ্বল হলেও রাজনৈতিকভাবে তারা অনুজ্জ্বল শুধু নন ইতোপূর্বেকার বিভিন্ন সংসদ নির্বাচনে জনগণের দ্বারা পরীক্ষিতভাবে পরিত্যক্তও হয়েছেন। এদের কেউ কেউ আবার বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগের সময় ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’-এ তৎপর ও সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং তাদের প্রতি এ দেশের মানুষের সমর্থনে ‘জনশূন্যতা’ প্রমাণের বাকি কিছু নেই- যেটুকু বাকি আছে আসন্ন নির্বাচনে আমরা তারও প্রমাণ পাব। গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের এরূপ ঐক্যবদ্ধতা নিয়ে সাধারণের মনে প্রশ্নেরও অন্ত নেই। প্রশ্নের চেয়ে এক জাতীয় মানুষের উৎসাহও আছে মাত্রাতিরিক্ত। আর গণমাধ্যম তো ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে! খবর ও খবরের পেছনকার খবর বের করার উদ্যমী প্রচেষ্টাও তাদের নিরন্তর- আপসহীনও। ফলে নবগঠিত ঐক্যের পশ্চাতে যে গভীর ষড়যন্ত্র সক্রিয় তাও কোনো কোনো গণমাধ্যমেরই আবিষ্কার!

সাম্প্রতিককালের বহু কাক্সিক্ষত ঐক্যে আগ্রহী নেতাদের কথা আর বিএনপি ও বিশ দলীয় জোটের কথাবার্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারাও বিএনপির মতো অভিযোগ উত্থাপন করে বলছে যে, দেশ এখন এক ব্যাপক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে! দেশের মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে জীবনযাপন করছে ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেই বুঝা যায় যে, একমাত্র জনরোষের কারণে যারা ক্ষমতা থেকে দীর্ঘদিন ধরে দূরে পড়ে আছে ক্রান্তিকাল কেবল তাদেরই। আর ক্ষমতার বাইরে থেকে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভোগবিলাসের জীবন থেকে দূরে ছিটকে পড়ে তাদের জীবনেই কেবল নেমে এসেছে দুর্ভোগ! প্রকৃতপক্ষে দেশের জনগণের মধ্যে দুর্ভোগ নেই। নিজেদের দুর্ভোগের কথা জনগণের নামে চালিয়ে দেয়ার হীন প্রচেষ্টা তাদের গভীরতম রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এ দেশের মানুষ বরং নিজ নিজ ভাগ্য ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের হার অনেক উন্নত রাষ্ট্রের চেয়েও কম নয়। বিগত দশ বছরে আমদের দেশটি যেভাবে অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তা অতীতের সব রেকর্ডও ভঙ্গ করেছে। নিম্ন আয়ের দেশের তকমা এখন আর বাংলাদেশের ভাগ্যে নেই। একটি সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এবং একই সঙ্গে মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়া সক্রিয় আছে বলেই দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উদ্যমী ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের কল্যাণে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের এই পরিবর্তন-উন্নয়ন। এখন উন্নয়নশীল দেশসমূহকে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে গ্রহণের জন্য উন্নত রাষ্ট্রের মুরব্বিরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শও দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশের মতো’ হওয়ার আকাক্সক্ষা গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা অবগত হয়েছি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রাথমিক সব শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে এখন আমরা উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছি। এ স্বপ্ন জননেত্রী শেখ হাসিনাই দেশবাসীকে দেখিয়েছেন- আর কেউ নন।

লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের এই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন মানসিকতা ও দর্শন লালন করা ব্যক্তিরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় একই মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। যে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই পাকিস্তানি আদর্শপুষ্ট সুশীল ব্যক্তিরাও এই মঞ্চাভিনয়ে নেমেছেন দেখে বিস্মিত হতে হয়! এর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এবং স্বাধীনতার পক্ষশক্তি বলে দাবি করা ব্যক্তিরা আছেন। সমাজের সচেতন ও সুশীল বলে এবং ন্যায়বান ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিষ্ঠিতরাও যুক্ত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এককালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী এবং পরবর্তীকালে ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ও বিচারিক আদালতে শাস্তিপ্রাপ্তদের সঙ্গে সুশীলদের এহেন ভ্রষ্টাচার দেখে এই বিশ্বাসই আমাদের দৃঢ় হয় যে, তথাকথিত সুশীল ও সচেতন নাগরিকরা যত ভালো কাজেই ঐক্যবদ্ধ হন না কেন এ দেশের মানুষ তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে সহজভাবে গ্রহণ করার কথাও নয়। তাদের ‘পায়ে পায়ে ষড়যন্ত্র, তাদের রা’য়ে রা’য়ে ষড়যন্ত্র’!

নবগঠিত ঐক্যের মূল কথা ও কাজ হলো ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগকে হঠাতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগের অপরাধ হলো তাদের শাসনামলে এ দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, বিচারিক আদালতে রায় ঘোষিত হয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলারও। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় অপরাধ আওয়ামী লীগের আর কি হতে পারে! তা ছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে। ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে। আসছে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অন্যান্য শর্ত পূরণের লক্ষ্যে যখন সফলভাবে এগিয়ে চলেছে তখন আওয়ামী লীগের গতিশীল নেতৃত্বকে থামিয়ে সেখানে বিএনপি জামায়াতকে পুনর্বাসন করার প্রত্যয়ে এক ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে ক্ষমতা লাভ ও লোভের আশাবাদী তথা অলীক-স্বপ্নবাদী কিছু মানুষ। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, আওয়ামী লীগ হঠানোর জন্য দিকে দিকে যে ঐক্যের রব উঠেছিল তার মধ্যে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র ছিল ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যেও। সামান্য একটি ঐক্য গঠনের শুরুতেই যদি আমরা ‘কাড়াকাড়ি’ ও ‘হুড়োহুড়ি’ দেখি তবে ক্ষমতা লাভের পর তাদের মল্লযুদ্ধ কে থামাবে তা ভেবে পাই না। সব দেখেশুনে এই প্রবোধে আমরা আশ্বস্ত হই যে, এসব জ্ঞানপাপীদের ঐক্যবদ্ধ হুল্লুড়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনোই নিজেদের যুক্ত করবে না। সাদা চোখে যা ভালো তাই তারা করবেন দ্বিধাহীন চিত্তে। শেষ পর্যন্ত সব উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে। আসন্ন নির্বাচনে সাধারণ মানুষেরই জয় নিশ্চিত হবে।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App