×

মুক্তচিন্তা

দরকার খাল-বিল-ডোবার অস্তিত্ব রক্ষা করা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:০০ পিএম

গ্রামবাংলার নদী-খাল-বিলগুলো আছে আজ সংকটাপন্ন অবস্থায়। দিন দিন নাব্য হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ফলে প্রকৃতিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব, এতে অনেক জলজ প্রাণীও পড়ছে বিলুপ্তির পথে। এক সময় খাল-বিলে নৌকা চলত, পাল তোলা নৌকা আর দেখা মেলে না। পানির অভাবে জমিতে শাপলা-শালুক নেই। হাঁস-পানকৌড়ি, ডাহুক-কোড়া আর নজরে পড়ে না।

সবুজ-শ্যামল-সুন্দর ও মনোরম দেশ বাংলাদেশ। দেশটির মাটি উর্বর। যেখানেই ভালো বীজ বপন করা হয় গাছ উঠে। এই দেশটি নদী-নালা-খাল-বিলের দেশ, পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত দেশ। নান্দনিক এই দেশটি দেশ-বিদেশের সবার মন কাড়ে। দীর্ঘকাল শোষণ-লুণ্ঠনের কারণে এই দেশের মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, এগুতে পারেনি। আজ দেশের উন্নয়ন-উৎপাদন, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সব বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিজেদের হাতে। যাতায়াত ব্যবস্থায় সড়কপথের উন্নয়ন যতটা নজরে পড়ে নৌপথসহ অন্যান্য যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন তেমন নজরে আসে না। আমরা জানি যাতায়াত ব্যবস্থায় নৌপথ স্বল্প ব্যয়ের খাত, মেরামত ও সংস্কারে খরচ কম হয়। নদী-নালা-খাল-বিলের দেশটিতে নৌচলাচলের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলের হাট বা বাজারগুলো বেশিরভাগই নদীর পাড়ে। নৌপথের মেরামতে খরচ কমের কারণে যাতায়াত খরচও কম হয়। তাই নৌপথের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যাতায়াত ব্যবস্থায় সমান তালে এগিয়ে না গেলে হোঁচট খাওয়া স্বাভাবিক হবে। নৌপথের প্রতি সমান গুরুত্ব না দিলে নদীমাতৃক দেশটির নৌপথ নিঃশেষ হবে। এক সময় বিরূপ প্রভাব পড়বে প্রকৃতিতে। সেই দিক বিবেচনায় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক এগিয়ে যাওয়া মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার। দরকার শিক্ষা-সংস্কৃতি ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে আরো বেশি নজর দেয়া। জনগণকে সচেতন করা, জাগিয়ে তোলা। আমরা জানি অলস-অথর্ব লোক সমাজের বোঝা তাই জনগোষ্ঠীর সব হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা দরকার।

দেশের মানুষকে সচেতন করতে প্রচার মাধ্যমগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। মানুষকে পরিশ্রমী হতে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। প্রতিটি পরিবারে কাজের লোক অর্থাৎ বুয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে পরিশ্রমী করে। খাবার শেষে টেবিল গুছানো, গোসলের সময় নিজের কাপড় নিজে ধোয়া, শুকাতে দেয়া, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজতে গিয়ে পানির অপচয় না করা, যথাসময়ে পড়তে বসানো জরুরি। দরকার সন্তান লেখাপড়ায় মনোযোগী কিনা খেয়াল রাখা, ভালো বন্ধুর সঙ্গে চলে কিনা সেই নজরদারি থাকতে হবে। তা ছাড়া সন্তানকে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা একটি বড় কাজ। আজকাল লক্ষ করা যায়, গ্রামের অনেক খেলার মাঠ বেদখল হয়ে গেছে। তাইতো হাডুডু-গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, কানামাছিসহ অনেক খেলা বিলুপ্তির পথে। মনে রাখা দরকার খেলাধুলা না করলে সন্তান শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠবে। আগে গ্রামে পালা গান, যাত্রা, নাটক, জারিগান, মঞ্চস্থ হতো। এখন আর এসব কার্যক্রম দেখা যায় না। এতে সংস্কৃতি কর্মীর অভাব হওয়াটা স্বাভাবিক। এই অভাব দূর করতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি কার্যক্রম চালু করা অপরিহার্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত-নাচ-গান শেখানোসহ অভিনয় শিখানোর ব্যবস্থাও রাখা দরকার। পৃথিবীর সব দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ একরকম নয়, আমরা জানি অনেক দেশ আছে শুধু ধু-ধু মরুভূমি। আবার অনেক দেশ বছরের অধিকাংশ সময় বরফে ঢাকা থাকে। অনেক দেশ শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সমতল ভূমি তেমন নেই, অনেক দেশ আছে পাথরের ভূমি। অনেক দেশ বছরের অর্ধেক সময় সূর্যের দেখা পায় না, ঘড়ির কাঁটার ওপর নির্ভর করে চলে। তাইতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। এ দেশের প্রকৃতিকে ভালো বাসার কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাস, জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফাসহ শত শত নন্দিত কবি-সাহিত্যিক সৃষ্টি হয়েছে এই দেশে। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।

কিন্তু লক্ষ করা যায়, গ্রামবাংলার নদী-খাল-বিলগুলো আছে আজ সংকটাপন্ন অবস্থায়। দিন দিন নাব্য হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ফলে প্রকৃতিতে পড়ছে বিরূপ প্রভাব, এতে অনেক জলজ প্রাণীও পড়ছে বিলুপ্তির পথে। খাল-বিলে হচ্ছে পানির অভাব, সার্ফেস ওয়াটারের অভাবে কৃষিকাজে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এক সময় খাল-বিলে নৌকা চলত, পাল তোলা নৌকা আর দেখা মেলে না। মাঝি মনের আনন্দে আর গান গায় না। পানির অভাবে জমিতে শাপলা-শালুক নেই। হাঁস-পানকৌড়ি, ডাহুক-কোড়া আর নজরে পড়ে না।

এক সময় গ্রামে প্রচুর খাল ছিল, এতে প্রচুর প্রাকৃতিক মাছ পাওয়া যেত, খালগুলো পড়েছে দখলদারের কবলে, অনেক খাল ভরাট হয়েছে, হচ্ছে অস্তিত্বহীন। দেশের কিছু নদীও আছে অনুরূপ পরিণতিতে। তা ছাড়া পুকুরগুলোও সংস্কারের অভাবে এক সময় পানিশূন্য হয়। চৈত্র-বৈশাখের আগেই দেশে পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয়, আবহাওয়া আর্দ্রতাহীন হয়ে ভাপসা গরম পরিলক্ষিত হয়। ভাটির দেশ-পানির দেশের মানুষের জন্য এটা অশুভ লক্ষণ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে। নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে। খাল-ডোবা রক্ষা করতে হবে। এর প্রভাবে আর্দ্রতাহীন অবস্থায় মানুষ-জীবজন্তু গরমে অতিষ্ঠ হয়। দেখা দেয় প্রাকৃতিক মাছের অভাব, এতে অনেক জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। লক্ষ করা যায় গ্রামের পুকুর পাড় হয়ে পড়েছে বৃক্ষ তরুলতাহীন, আগের মতো ঝোপঝাড় নেই। শিয়াল-ডাহুক-কোড়াসহ অনেক পশু-পাখি আর দেখা মেলে না। আগে প্রতি বাড়িতে কৃষকের গোয়াল ভরা গরু ছিল। কৃষক গরুর গোবর সার হিসেবে ব্যবহার করত। বাড়ির পাশে কোলা জমিতে কৃষক টমেটো-আদা-পেঁয়াজ-রসুন আবাদ করত, ইদানীং এমনটা আর নজরে পড়ে না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে এসব ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখা দরকার। এ বিষয়ে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। নিজের দেশের পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে তৎপরতা দরকার। পণ্য প্রাপ্তি ও ব্যবহারে রক্ষণাবেক্ষণে সচেতনতা দরকার। আর দরকার দেশে দক্ষ জনবল তৈরি।

মো. এনামুল হক খান : প্রকৌশলী, সংগঠক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App