×

মুক্তচিন্তা

ঘুণপোকাগ্রস্ত মার্কিন গণতন্ত্র

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:২৫ পিএম

ট্রাম্পের গৃহীত কৌশল ও পদক্ষেপের শিকড় মার্কিন রাজনৈতিক চর্চার অতীতে নিহিত। রিগ্যান ও বুশ প্রশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল করপোরেশনের ওপর থেকে কর হ্রাস, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার অনিশ্চয়তা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ইত্যাদি। ‘বিকল্প সত্য’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবিষ্কার নয়। তিনি এটা জর্জ বুশের কাছ থেকে ধার করেছেন।

এ বছর ২১ জানুয়ারি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘এভাবেই গণতন্ত্ররা মারা যায়’ শিরোনামে স্টিভেন লেভিৎস্কি ও ড্যানিয়েল জিবল্যাটের একটি যৌথ রচনা প্রকাশিত হয় যা আসলে তাদের ‘গণতন্ত্র যেভাবে মরে’ শীর্ষক বই থেকে একটি উদ্ধৃতাংশ। এখানে লেখক দুজন লিখেছেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মর্মান্তিক দিকটা হলো গণতন্ত্রের হত্যাকারীরা ঠিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ব্যবহার করে ধীরেসুস্থে, সূক্ষ্মভাবে ও আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে হত্যা করার জন্য ... আমাদের গণতান্ত্রিক আদর্শসমূহের অবক্ষয় শুরু হয়েছে ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশক থেকে আর একবিংশ শতকের ১ম দশকে তা বিশেষভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে। ... ট্রাম্প এই গতিবৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারেন, তবে তিনি এর কারণ নন। মার্কিন গণতন্ত্র যেসব হুমকির মুখে তা গভীরে প্রোথিত।

অতএব কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিরজীবী নয়, মরণশীল। পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের শিশু জন্মলাভ করে তারুণ্য ও যৌবনপ্রাপ্ত হতে পারে, আবার অকালে তা ঝরেও পড়তে পারে। মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগ তাই বাস্তবভিত্তিক ও ব্যাপক বিস্তৃত। ট্রাম্পের রাজত্ব চলাকালে এ উদ্বেগ প্রতিদিনই আরো শক্তিশালী ও তীব্র হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শ ও মূল্যবোধসমূহ যেভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবহেলিত ও মলিন হচ্ছে তার চিহ্ন প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। এ রকম কয়েকটি বিষয়ের দিকে এখন নজর দেয়া যাক।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি পদে ট্রাম্প-মনোনীত বিচারক ব্রেট কাভানোর সমর্থনলাভ প্রমাণ করল দেশটির বিচারব্যবস্থা কী ভীষণরকম দলীয় ও অগণতান্ত্রিক। যে ব্যক্তি যৌন হয়রানির অভিযোগে পরিষ্কারভাবে অভিযুক্ত তাকে মনোনয়নের জন্য সিনেটে যে হাড্ডাহাড্ডি ভোটের লড়াই হলো, তা থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র কী ভয়ানক রকমে বিভক্ত। মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থায় নীতিনৈতিকতার পোশাকটি ছিন্নভিন্ন হলো এর মাধ্যমে। এ ব্যাপারে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান লেখেন, ব্রেট কাভানোর নিয়োগলাভ দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকার জন্য কী অর্থ বহন করে তা নিয়ে বহু মানুষ যথার্থভাবেই উদ্বিগ্ন। ... সর্বোচ্চ আদালতে এমন এক ব্যক্তিকে বসানোয় আগামী দিনে আদালতের নৈতিক কর্তৃত্ব এক আঁচড়ে বিলীন হয়ে যায়। (দ্য প্যারানয়েড স্টাইল ইন জিওপি পলিটিক্স, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ৮ অক্টোবর ২০১৮)

মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও নীতিমালায় বারাক ওবামার যত প্রবর্তন ও অর্জন তার সব উল্টে দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে প্রাণপণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বিপজ্জনক পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আরেক নোবেল-বিজয়ী অর্থনীতি যোশেফ স্টিগলিজ লেখেন, ‘ট্রাম্প অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত করে স্বল্পসংখ্যক মানুষের স্বার্থরক্ষার অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি আমেরিকাকে নিয়ে যাচ্ছেন জাতিবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, আঞ্চলিকতা, কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার পথে। তিনি ও তার রিপাবলিকান অনুচরেরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ও গোয়েন্দা সংস্থার মতো সত্যভাষী প্রতিষ্ঠানসহ আমেরিকার সব নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন করছেন। বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব কোনো কিছু টেনে ধরা, যখন কিনা অন্যরা ব্যর্থ হয়। এখন যেহেতু সর্বোচ্চ আদালত ট্রাম্পের সঙ্গে তার ভাগ্যকে জুড়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সত্যি হুমকির মুখে।’ (আমেরিকান ডেমোক্রেসি অন দ্য ব্রিংক, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮)

ডেনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে অবশ্য মনে করা হতো যে, আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রাজনৈতিক বিচ্যুতির আঘাত ও সরকারের যে কোনো পর্যায়ের ব্যক্তিগত আক্রমণ সহ্য করে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে। এখন দেখা যাচ্ছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানসমূহ মোটেও ততখানি সহনশীল ও শক্তিশালী নয়। মার্কিন বিচারব্যবস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদি সবকিছুকেই ট্রাম্পের মতো কেউ ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারেন যদি তিনি কেবল ক্ষমতা ও টাকার মালিক হন। তবে গভীর কারণসমূহের দিকে না তাকিয়ে এসবের জন্য শুধু ব্যক্তি ট্রাম্পকে দোষারোপ করা ভুল হবে। সেজন্যই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, ট্রাম্প এ ব্যবস্থা পচনের জন্য দায়ী নন, তিনি এ পচনের ফল। (১০ অক্টোবর ২০১৮ জ্যাকোবিন সাময়িকীতে মিগান দে-র লেখা বার্নি’স নিউ ইন্টারন্যাশনালিস্ট ভিশন)

ট্রাম্পের গৃহীত কৌশল ও পদক্ষেপের শিকড় মার্কিন রাজনৈতিক চর্চার অতীতে নিহিত। রিগ্যান ও বুশ প্রশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল করপোরেশনের ওপর থেকে কর হ্রাস, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার অনিশ্চয়তা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো ইত্যাদি। ‘বিকল্প সত্য’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবিষ্কার নয়। তিনি এটা জর্জ বুশের কাছ থেকে ধার করেছেন। সাদ্দাম হোসেন যে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মালিক ও পারমাণবিক অস্ত্র বানানো শেষ করে ফেলেছেন বুশ এই সত্য উৎপাদন করেছিলেন ও কৃত্রিম বাস্তবতা তৈরি করে আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করেন। ট্রাম্প যুগে বিকল্প সত্য আরেক ধাপ এগিয়েছে। পল ক্রুগম্যান নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে লিখেছেন, এখন তারা বলছে ‘আসলে কালো হচ্ছে সাদা আর ওপর হচ্ছে নিচ।’ পুরোদমে জর্জ অরওয়েল!

জর্জ অরওয়েল তার ‘১৯৮৪’ শীর্ষক উপন্যাসে যে বিগ ব্রাদারের কথা বলেছেন, ট্রাম্প এখন তাই। কেবল কর্তৃত্বপরায়ণতার জন্য নয় বা নিউস্পিক নামের উদ্ভট ভাষা ও ডাবলথিঙ্ক নামের দ্বিচারী চিন্তার জন্য নয়, ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই অন্য যে কারো চেয়ে নাকি বড় সেই সূত্রে। আর যারা তার শত্রু তারা ‘ছোট’ ও ‘ভুয়া’। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন গত বছরে ছিলেন লিটল রকেট ম্যান। এবার তিনি ট্রাম্পের বড় বন্ধু কারণ তারা দুজন একসঙ্গে বসে নাকি পরমাণবিক অস্ত্র হ্রাসের এমন এক চুক্তি করেছেন যা খালি চোখে দেখা যায় না। প্যারিসের জলবায়ু চুক্তিকে ট্রাম্প ছিঁড়ে ফেলেছেন, কারণ উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন তার ভাষায় ভুয়া ও চীনা কারসাজি। এখন ইরানের বিরুদ্ধে লাগানো হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের বিকল্প সত্য ও কৃত্রিম বাস্তবতা তৈরির দানবীয় যন্ত্রকে।

ট্রাম্পের হাতে আব্রাহাম লিঙ্কন কথিত ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার’ পরিণত হয়েছে ‘করপোরেশনের জন্য, করপোরেশনের দ্বারা, করপোরেশনের সরকারে’। এই রূপান্তরের কথাটি বলে দিয়েছেন যোশেফ স্টিগলিজ তার উপরোল্লিখিত নিবন্ধে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন টাকার শাসন চলছে, জনগণের নয়। সংবিধানে যাই থাকুক। স্টিগলিজ তাই লিখেছেন, ‘পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে মার্কিন রাজনীতিতে টাকাই বিষয়।’ যদিও তিনি আশা রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের শক্তির ওপর। (মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনে জনগণ বনাম টাকা, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ১১ অক্টোবর ২০১৮)

জনগণ ও টাকার থলের এই দ্বৈরথ দেখার জন্য সবাইকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মার্কিন গণতন্ত্রের ভাগ্য নির্ভর করছে সেই ফলের ওপর।

আলমগীর খান : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App