×

মুক্তচিন্তা

ড. কামাল বিএনপি-জামায়াতের পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব নিয়েছেন

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:৩০ পিএম

ড. কামাল হোসেনকে সম্মুখে নিয়ে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে বহির্বিশ্বে একটি ধারণা তৈরি করা, জামায়াত-বিএনপির গাঁটছড়া অবস্থা সম্পর্কে এতদিনকার দেয়া বার্তাকে এবার ভুল প্রমাণিত করা, এবার যেন পশ্চিমা বিশ্ব এটিকে ২০ দলীয় জোট হিসেবে নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের একটি চেহারাও তারা দেখাতে চায়।

ড. কামাল হোসেন অবশেষে নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টের প্রধান হলেন। ফ্রন্ট থেকে ছিটকে পড়েছেন বিকল্প ধারার প্রধান ডা. বি চৌধুরী ও মাহী বি চৌধুরীও। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, বিএনপি ড. কামালকে যতটা আস্থায় নিতে পেরেছে, বি চৌধুরীকে তা পারেনি। ফলে কিক আউটির নেপথ্যে বিএনপির নানা হিসাব-নিকাশই প্রধান বলে সবার ধারণা। ড. কামাল জীবনভর যে রাজনীতির সংস্কৃতিতে যুক্ত ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীতেই বিএনপির রাজনীতি। ডা. বি চৌধুরী বিএনপি-জামায়াতকে যেভাবে ১৯৭৮ সাল থেকে চেনেন, ড. কামাল তার ধারেকাছেও যেতে পারার কথা নয়। ফলে ড. কামালকে ব্যবহার করতে নেপথ্যে থেকে ২০ দল যতটা সফল হবে, ডা. বি চৌধুরী থাকলে সম্ভব না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং যুক্তফ্রন্টসহ যে বৃহত্তর ঐক্য গঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত বিএনপির হিসাব-নিকাশ থেকেই অন্য রকম হয়েছে। কেননা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত জামায়াত যারা এখন নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়াবে- যা বি চৌধুরী যত সহজেই ধরতে পারবেন, ড. কামাল হোসেন তা পারার কথা নয়। ড. কামাল এখন রাজনীতিতে একজন প্রায় নিঃস্ব মানুষ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ আগে দেশে-বিদেশে যেভাবে তাকে জানত এখন সেই যুগ তার জন্য নেই। তিনি এখন বয়স এবং রাজনীতিতে পড়ন্ত একটি পর্যায়ে চলে এসেছেন। তার জীবনের তেমন সময়ে বিএনপি এবং জামায়াতের বিবেচনায় ড. কামাল হোসেন তাদের পুনরুজ্জীবনে হয়তো ভীষণভাবে কাজে লাগবেন।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে আছেন, শরীরও তার ভালো নেই। অন্যদিকে তারেক রহমানের নানা ধরনের কারাদ- এবং নির্বাসন দলকে অনেকটাই নেতৃত্ব শূন্যতায় ফেলে দিয়েছে। দলে অনেক বাঘা বাঘা নেতা থাকলেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে কেউ কারো নেতৃত্ব মেনে নেবেন এমন বাস্তবতা দলে নেই। ফলে বিএনপি তারেক রহমানের রিমোট কন্ট্রোলে চললেও দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দাঁড় করাতে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে কিংবা একটা কিছু ঘটাতে একজন বিকল্প নেতার তীব্রভাবে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। বিএনপির বিবেচনায় ড. কামাল হোসেন সেই ভূমিকাটি জোটগত শীর্ষ নেতার অবস্থান থেকে পালন করতে পারেন। বিএনপির জন্য এ মুহূর্তে তেমন একজন ছায়া নেতার বিশেষ প্রয়োজন। কেননা গেল ক’বছর একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি বেশ বিপাকে পড়েছে। বিশেষত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার কৌশল নিয়ে শেষ পর্যন্ত দল এবং ২০ দলীয় জোট যে সংকটে পড়ে তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিএনপির মতো এত বড় দল দেশে গত ৫ বছরে রাজনৈতিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এর কৃতিত্ব যতটা না সরকারি দল আওয়ামী লীগের তার চাইতে ঢের বেশি নিজেদের ভুলের। বিশেষত জামায়াতের ক্যাডার, ভোটার এবং অর্থবিত্তের ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি কতটা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে- তা কেবল নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলেই বোঝা সম্ভব। অন্যদিকে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে ১৯৭১ সাল থেকে স্বীকৃত হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় দলটি কেবলই শক্তি অর্জন করেছে, বিএনপির আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। জামায়াত ভাবতে পারেনি, বাংলাদেশে কোনোদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি উঠবে, তাদের শীর্ষ নেতারা একের পর এক বিচারে দ-প্রাপ্ত হবেন। কিন্তু তরুণদের দাবির ফলে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বড় ধরনের গণরায় নিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতায় এসে বিচারের জন্য আদালত গঠন এবং মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করার পরও জামায়াত-বিএনপির ধারণা ছিল তেমন কিছু হবে না, সরকার লোক দেখানো বা প্রতীকী বিচারের বেশি কিছু হয়তো করবে না। কেননা জামায়াতের পাশে ছিল বিএনপি। ফলে বিএনপির চাপে সরকার হয়তো সিরিয়াস থাকবে না। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে বিচার চলতে থাকে।

জামায়াত দেশি-বিদেশি লবিস্ট নিয়োগ করেও পার পায়নি। তাদের ধারণা ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার মাধ্যমে তারা উল্টো আওয়ামী লীগকেই শায়েস্তা করতে পারবে। সে কারণে গত নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জামায়াত এবং বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বানচালও করা যায়নি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও থামানো গেল না। শেখ হাসিনা বিচারের গতি স্বাভাবিক রাখায় জামায়াতের মূল শীর্ষ নেতারা দণ্ড পেয়ে শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হলেন। জামায়াত দল হিসেবে সবচাইতে বড় সংকটে পড়েছে। যদিও দলটি তৃণমূলে তাদের অবস্থান ধরে রাখার প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু দলের শীর্ষ পদ এখন সেভাবে পূরণ হচ্ছে না, সরকারবিরোধী আন্দোলনও সেভাবে দাঁড় করাতে পারছে না। আওয়ামী লীগের পর পর দুই মেয়াদের শাসনের ফলে রাজনীতিতে গুণগত যে পরিবর্তন এসেছে- সেটি আওয়ামী লীগ দলগতভাবে তুলে ধরতে পারছে না, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী বলে দলগুলোও তা সর্বান্তকরণে সমর্থন করেও না, কেননা রাজনীতির বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে অবস্থান নেয়ার দল ও ব্যক্তি দেশে খুব বেশি নেই। যদি থাকত তাহলে দেশের রাজনীতি নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যে এমন বিভ্রান্ত ও বিভক্তি থাকত না। বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনীতির বর্তমান সংকটের মূলে সরকারের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাকে যারা এককভাবে ভাবেন তারা বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র উন্মোচনের ক্ষমতা কতখানি রাখেন তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর করার পাশাপাশি একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ফলে এতদিন জামায়াত-বিএনপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শক্তি হিসেবে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল তাতে বড় ধরনের ছেদ পড়ে, বিএনপি-জামায়াত বড় ধরনের ধাক্কা খেল, সংকটে পড়ে। সেই সংকট এখন কতটা প্রকট তা দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থান দেখেই বোঝা যায়। দল দুটি ভাবতেই পারেনি তারা এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে পড়বে।

সে কারণেই তারা এখন ছায়া নেতার আশ্রয়ের কৌশল গ্রহণ করেছে। ড. কামাল হোসেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিএনপি-জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি হয়তো বুঝতেই পারছেন না, তাকে কেন বিএনপির এত প্রয়োজন? কেন বিএনপি নেতারা তার পেছনে ছুটছেন? এতদিন তো তারা তা করেননি? কেন করেননি- তা স্পষ্ট। যে করেই হোক আগামী নির্বাচন নিয়ে যদি কিছু একটা করা যায় তাহলে দেশে বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরুজ্জীবন সহজেই ঘটানো সম্ভব। যদি আওয়ামী লীগকে হটানো যায় তাহলে তো কথাই নেই, দেশে আবার জামায়াত-বিএনপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা বেগবান হবে, অসাম্প্রদায়িক ধারাকে কীভাবে বিলুপ্ত করতে হবে- সেটিতো তারা বেশ ভালোভাবে জানেই। সুতরাং এই মুহূর্তে জরুরি কাজ হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে হলে নানা কৌশল অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই। ২০ দলীয় জোটকে যথাযথ রেখে নতুন একটি জোট গঠনের মাধ্যমে মানুষকে গণতন্ত্র, সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে একত্রিত করা গেলে হয়তো একটা কিছু হতে পারে। জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে ভিন্ন কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেবে। ধারণা করা হচ্ছে যেহেতু দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে, তাই জামায়াত স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে চিহ্নিত আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, আবার বিএনপির প্রার্থী কেউ কেউ মনোনয়ন নিতে পারে। বিষয়গুলো নিয়ে দুই দলের কৌশল একেবারেই গোপনে চলবে- এটি প্রায় নিশ্চিত। তবে তারা ড. কামাল হোসেনকে সম্মুখে নিয়ে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে বহির্বিশ্বে একটি ধারণা তৈরি করা, জামায়াত-বিএনপির গাঁটছড়া অবস্থা সম্পর্কে এতদিনকার দেয়া বার্তাকে এবার ভুল প্রমাণিত করা, এবার যেন পশ্চিমা বিশ্ব এটিকে ২০ দলীয় জোট হিসেবে নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের একটি চেহারাও তারা দেখাতে চায়। একই সঙ্গে বর্তমান সরকার সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়ার পরিকল্পনাও এতে রয়েছে- যেখানে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, সরকার কারচুপির নির্বাচন করতেই তাদের দাবি মানছে না।

ড. কামাল হোসেনকে সম্মুখে নিয়ে জামায়াত-বিএনপি সংবিধান, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দোহাই দিয়ে যদি জনমত সৃষ্টি করতে পারে, প্রতিবেশী দেশ, ইইউসহ উন্নত দুনিয়ার সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে জামায়াত-বিএনপির ধারণা নির্বাচনে তারা ভালো ফলাফল করতে পারবে। বিএনপির নেতারা প্রায়ই দাবি করে থাকেন যে, জনগণ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করতে, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে মুখিয়ে আছে। এসব দাবি মুখের কথা, বাস্তবে দেখা যাবে নির্বাচনের পরই। কিন্তু সেই নির্বাচন নিয়ে এ মুহূর্তে যেসব দাবি উত্থাপিত হয়েছে নবগঠিত ফ্রন্টের পক্ষ থেকে, সেগুলো এ মুহূর্তে কতটা ইস্যু হয়ে উঠবে, কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে- সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তবে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে চায়- এমন কথা সরকারের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকবারই বলেছেন যে জনগণ ভোট দিলে তিনি ক্ষমতায় আসবেন, না দিলে আসবেন না। এরপরও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন সংবিধানের বাইরে গিয়ে এখন নির্দলীয় সরকার গঠন, সংসদ ভেঙে দেয়া ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে আসলে কী জামায়াত-বিএনপির নির্বাচন বানচালের কোনো কৌশল বাস্তবায়নে পা দিচ্ছেন, নাকি দেশে অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির বিকাশকে তৃতীয়বারের মতো সংকটে ফেলতে ক্রীড়নকে পরিণত হতে যাচ্ছেন- সেটিই দেখার বিষয়। পুরো বিষয়গুলোই বেশ জটিল এবং সন্দেহের নানা ছিদ্র তৈরি করছে। দেশের অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতি ও সামাজিক শক্তিসমূহ, সরকার এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে সজাগ থাকতেই হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App