×

মুক্তচিন্তা

অসুরদলনী দুর্গার আরাধনা

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:২২ পিএম

অসুরদলনী দুর্গার আরাধনা
অসুরদলনী দুর্গার আরাধনা

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শারদীয় উৎসব উদযাপনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমে। কিন্তু এই আরাধনা কেবল যেন উৎসবের আনন্দ উপভোগের মধ্যে সীমিত হয়ে না পড়ে। যেন অসুরদলনী যুদ্ধরত বিশ্বমাতার দিকে তাকালেই মনে পড়ে, অশুভশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা। প্রতিটি অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অন্তরের দুর্গাকে জাগিয়ে তোলার শপথ। তাহলেই ভালোবাসা, প্রেম ও করুণার স্পর্শে সুস্থতা ফিরে পাবে জরাগ্রস্ত মনুষ্যত্ব। সার্থক হয়ে উঠবে প্রতি বছর অসুরদলনী দুর্গার আরাধনা।

অসুরদলনী দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসেন যুদ্ধরত অবস্থায় দশভুজারূপে। যার অর্থ, জগতের দশদিককে দুষ্ট শক্তির প্রবল প্রতাপ থেকে তিনি রক্ষা করতে প্রস্তুত। মহাবিশ্বের বিশ্বেশ্বরী দুর্গা, ঈশ্বরের নারীরূপ। সনাতন ধর্মে এই দেবী বিশ্বের ত্রাণকর্ত্রী। বিশ্বস্রষ্টার কল্যাণময় পরাশক্তির প্রকাশ। পরাক্রমশীল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শান্তি, কল্যাণ এবং শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জগতের দুর্গতি নাশ করেন বলে তিনি ‘দুর্গা’ নামে অভিহিত। অন্তহীনকাল ধরেই অশুভ শক্তির জাগরণে শুভশক্তির বিপর্যয় ঘটে বারবার। অবশেষে কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অসুর শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় শান্তি আর সৌহার্দ্যরে বন্ধন। এটা জগতের চিরকালীন জাগতিক নিয়ম। চক্রাকারে এই ঘটনা তাই বারবার ঘুরেফিরে আসে। কারণ ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে এই অবস্থা হলো Check and Balance- এর খেলা। অর্থাৎ ভারসাম্য রক্ষা করার রহস্যময় কৌশল।

তাই অনাদিকাল ধরে জীবনসমুদ্র মন্থন করে শুভশক্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে নিরন্তর জন্ম নেয় সমশক্তিমানের অসুরকুল। তবে জগতে আসুরিক শক্তির বিকাশ যেমন একক শক্তির ওপর নির্ভর করে সম্ভব হয় না, তেমনি তাকে পরাস্ত করার জন্যও প্রয়োজন পড়ে শুভশক্তির সম্মিলন। সনাতন ধর্মের দেবী দুর্গা তাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরসহ অন্য দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রকাশিত রূপ। যখন অসুরদের অত্যাচারে সমাজে সুখ, শান্তি, সভ্যতা, উন্নয়নমূলক কাজ এবং মানবধর্ম বিঘ্নিত হয়, তখন সম্মিলিত শক্তির দ্বারা পরাস্ত করতে হয় তাকে। যেমন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো জটিল সমস্যা সমাধানে কিংবা সুচারুরূপে রাজ্য পরিচালনার কাজে সরকারের বিভিন্ন প্রশাসন নিজ নিজ ক্ষেত্রে থেকেও সংঘবদ্ধ ভূমিকা নিয়ে দায়িত্ব পালন করে। আবার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা প্রয়োজনে পালন করে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো।

সনাতন ধর্মের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং অন্য দেবতারা এই পৃথিবীরই মানবসমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন প্রতীকীরূপ। আবার তাঁরা প্রত্যেকে এক জগতস্রষ্টার ভিন্ন ভিন্ন শক্তির প্রকাশও বটে। ঈশ্বর যখন সৃষ্টিকর্তা তখন তিনি ব্রহ্মা।

পিতৃস্নেহে বিশ্বের প্রতিপালন করায় তিনি বিষ্ণু। নতুন সৃষ্টির প্রয়োজনে ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠলে ঈশ্বর হয়ে ওঠেন মহেশ্বর। আর অন্যসব দেবতা শাশ্বতকাল ধরে এই তিন পরাশক্তির কর্মধারাকেই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্বে সুগভীরভাবে নিয়োজিত। আসলে সনাতন ধর্ম কোনো প্রথাগত সম্প্রদায়ের ধর্মমত নয়। এই ধর্ম অন্তহীন জীবের চিরকালের পথ চলার পরিষ্কার নিশানা। যে পথে চলতে চলতে মানুষ মনুষ্যত্বধর্ম লাভ করে। মানুষ শাশ্বত সত্যের অনুসন্ধান পায়। তাই সনাতন ধর্ম মানব মনের, পুরো মানবসমাজের স্বচ্ছ কাচের দর্পণ হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতার দৃষ্টি উন্মোচিত হলে এই আয়নায় মানুষ জীবনসত্যকে প্রত্যক্ষ করে পৃথিবীতে সত্য, সুন্দর, প্রেম ও কল্যাণকে গৌরবভরে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করে। পৃথিবীর মানবসমাজে পবিত্র মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাই অসুরদলনী দুর্গাকে বারবার আবাহন করেন সনাতন ধর্মের অনুসারীরা।

সনাতন ধর্মের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাতা নেই। হাজার হাজার বছর ধরে জ্ঞানসাধকদের গভীর ধ্যানের উপলব্ধির ফসল নিয়ে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হয়েছে এই মানবধর্ম। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সাধকদের জ্ঞানের ধারা স্বচ্ছসলিলা নদীর মতো বয়ে গিয়েছে অবিরাম। প্রাচীনতম কাল থেকে আজ অবধি বিরামহীনভাবে সনাতন ধর্ম জীবনের কথা নানাভাবে, নানা ব্যাখ্যায় তাই শুনিয়ে এসেছে মানবজাতিকে। মানুষের প্রয়োজনে, কালের ব্যবধানে, সময়ের বিবর্তনে সমাজ সংস্কারকদের দ্বারা বহুবার সংস্কৃত হয়েছে এর ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ। কিন্তু তারপরও সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা, ঈশ্বরভক্ত সাধকরা জীবন, জগত এবং এর স্রষ্টা সম্পর্কে যে মর্মবাণী পৃথিবীতে রেখে গিয়েছেন, তার মূল ভাবনার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি কখনো। কারণ চিরন্তন জীবনের কথাই এর মূল উপপাদ্য বিষয়। তাই অসুর-দেবতার সংঘর্ষ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ মনুষ্যত্বলাভের কামনায় জাগরিত হয়েছে যুগে যুগে। রূপক-প্রতীকের মাধ্যমে অসুরদলনী দুর্গার কাহিনী শুনতে শুনতে অন্তরের অশুভ শক্তিকে দমনের জন্য সজাগ হয়েছে বারবার।

হিন্দুসমাজে প্রাচীনকাল থেকেই অসুরদলনী দেবী দুর্গার কাহিনী প্রচলিত। রামায়ণের কাহিনীতে দশরথ পুত্র শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কার পরাক্রমশালী রাজা রাবণের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রার আগে ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে, ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। লঙ্কারাজ রাবণ ছিলেন বিদ্বান, রূপবান, বুদ্ধিমান, শক্তিশালী, বিত্তবান। ঈশ্বরভক্তির কারণে নিয়মিত পূজার্চনার মাধ্যমে ব্রহ্মার আশীর্বাদপুষ্ট তিনি। কিন্তু তিনি ছিলেন অহংকারী, দুর্বিনীত, নির্মম, লোভী, ধৈর্যহীন এবং পরমত অসহিষ্ণু। বহু গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও ইন্দ্রিয় দমনে অক্ষম।

রামচন্দ্রের পতিব্রতা স্ত্রী সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে কৌশলে তাঁকে অপহরণ করেছেন। অসহায় সীতার আকুলতা উপেক্ষা করেছেন নিষ্ঠুরভাবে। অবজ্ঞায় ঔদ্ধত্যভরে অমান্য করেছেন বৃদ্ধ গড়ুরের মতো জ্ঞানবান ব্যক্তির উপদেশ। পরিণতিতে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে প্রচ- যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছেন রাবণের আত্মীয়পরিজন। বিধ্বস্ত হয়েছে বিশাল রাজ্যপাট। অবশেষে দশরথপুত্রের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন দুর্জয় লঙ্কারাজ দশানন। মহিষাষুর, চণ্ডাসুর, শুম্ভ, নিশুম্ভ, তারকাসুরসহ অজস্র অসুরবধের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতে। যারা প্রত্যেকেই বলবীর্যে শক্তিশালী। আপন ব্যক্তিত্বে প্রখর। কিন্তু ইন্দ্রিয়পরায়ণ, নিজের অন্ধ আবেগে অনড়, অপরিণামদর্শী। অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাহীন। পরের ধনসম্পদ অপহরণকারী। পররাজ্যের দখলদার। দুগতিনাশিনী দুর্গা যুগে যুগে এদের আসুরিকতা ধ্বংস করেছেন জগতে পুনরায় শান্তি স্থাপনের জন্য।

রামায়ণ, শ্রীচণ্ডীসহ অন্যান্য পুরাণ-উপপুরাণে দেবী দুর্গার অসুর নিধনের কাহিনী আসলে এই মানব সমাজেরই আগাগোড়া ইতিহাস। রূপক প্রতীকের অন্তরালে যেগুলো কাহিনী আকারে বিধৃত হয়েছে। দেব-দানবের যুদ্ধ চিরকাল চলছে পৃথিবীজুড়ে। চলবে অনাদিকাল। কারণ এই যুদ্ধ-সংগ্রাম মানব মনের শুভ-অশুভ এই দুই বিপরীত চেতনার সংঘর্ষ। মনুষ্যত্বের জাগরণে হৃদয়ের বলিষ্ঠতা জাগ্রত হলে দেবী দুর্গার বোধন ঘটে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অন্তরে। বিশ্বস্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে মানুষের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে এই পরমশক্তির ভাণ্ডার। প্রতি বছর দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে এই পরাশক্তিকে জাগিয়ে তোলার নির্দেশনা দেয় সনাতন ধর্ম। যাতে সুরশক্তির সম্মিলনে অসুরশক্তি পরাস্ত হয়।

এখন পৃথিবীব্যাপী প্রতি মুহূর্তেই অশুভ শক্তির বিস্তার। মনুষ্যত্ব জরাগ্রস্ত। বৌদ্ধসন্ত দালাইলামার কথায়- ‘লাভ এন্ড কম্প্যাশন আর নেসেসিটিস। উইথআউট দেম হিউম্যানিটি ক্যান নট সারভাইভ’। মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্তরের প্রেম, করুণা এবং সহানুভূতির প্রয়োজন। কারণ এগুলো ছাড়া মানবতা বেঁচে থাকতে পারে না।

দুর্গাপূজা এখন ভারত উপমহাদেশের বাইরেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বার্ষিক উৎসব হিসেবে পরিগণিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শারদীয় উৎসব উদযাপনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমে। কিন্তু এই আরাধনা কেবল যেন উৎসবের আনন্দ উপভোগের মধ্যে সীমিত হয়ে না পড়ে। যেন অসুরদলনী যুদ্ধরত বিশ্বমাতার দিকে তাকালেই মনে পড়ে, অশুভশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা। প্রতিটি অনৈতিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে অন্তরের দুর্গাকে জাগিয়ে তোলার শপথ। তাহলেই ভালোবাসা, প্রেম ও করুণার স্পর্শে সুস্থতা ফিরে পাবে জরাগ্রস্ত মনুষ্যত্ব। সার্থক হয়ে উঠবে প্রতি বছর অসুরদলনী দুর্গার আরাধনা।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App