×

মুক্তচিন্তা

২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী

Icon

কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৭:১২ পিএম

তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে একুশ শতকে পৃথিবী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বন পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ। তার মতে, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে একুশ শতক বিশ্ববাসীর জন্য হবে সম্ভাবনার আধার। পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য দূর করে মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলবে।

পৃথিবীতে ক্ষুধা নির্মূলের জন্য প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০টি দেশে ঘটা করে পলিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। ১৯৮১ সাল থেকে প্রথম এ দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হয়। ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের সব মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এ পৃথিবীতে প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন দরিদ্র মানুষ খাদ্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করছে। তাই বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কর্মসূচি ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনাহারী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য, খাদ্যদ্রব্যের অসম বণ্টন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতিগত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে তা আগামী ২০৫০ সালের আগে অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানান জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান।

পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করতে হলে আমাদের যে কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে সেগুলে হলো- এক. খাদ্যের অপচয় বন্ধ করতে হবে। দুই. অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। তিন. খাদ্যের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। চার. দারিদ্র্য দূর করতে হবে। পাঁচ. জাতিগত সংঘাত ও যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। ছয়. ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। সাত. অধিক স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আট. কমসংখ্যক উপকরণ ব্যবহার করে সহজে ও অল্প সময়ে পুষ্টিকর খাদ্য তৈরির কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। নয়. খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক চিন্তা-ভাবনাকে নিকটবর্তী স্থানীয় ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে। দশ. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষামূলক কর্মসূচি তৈরি করে তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার করতে হবে। পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীবৈচিত্র্য সংরক্ষণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- (our action our future, A zero hunger world by 2030 is possible) ‘কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব’। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীন। ১০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। শুধু যুদ্ধগত কারণেই নয়, সব দেশেরই বৃহদাংশ মানুষের জীবন অনাহার ও অপুষ্টির নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। এই ক্ষুধাতুর ও বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের শ্রম-ঘামের সুফল ভোগ করছে উঁচু তলার একভাগ মানুষ। মাত্র কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর বেশির ভাগ সম্পদ। ক্ষুধা, অসাম্য, অপচয় আর যুদ্ধের করতলে পিষ্ট পৃথিবী কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা চাই মানবিক ও শান্তির সমাজ।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য হলো- খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে সমন্বিত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। সীমিত সম্পদের এ দেশে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি। কৃষির উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমেই গ্রামীণ জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব। ফসলের পাশাপাশি মাছ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আর আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কথা হলো, ফসলের নিত্যনতুন জাত উদ্ভাবন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, মাটির গুণাগুণ বজায় রেখে পরিবেশসম্মত চাষাবাদের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও প্রাণিজ আমিষের লক্ষ্য পূরণে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য কৃষি গবেষণাসহ এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

বিশ্ব অনাহার সূচক ২০১৭ অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনাহারী মানুষের ১০টি দেশ হলো- সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ, সিয়েরালিয়েন, মাদাগাস্কার, জাম্বিয়া, ইয়েমেন, লাইবেরিয়া, সুদান, নাইজার ও তিমুর-লেস্তে। সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দেশ। জাতিগত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটিতে ২০১২ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদনে ধস নামে। ফলে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ অনাহার ও অপুষ্টির শিকার। দীর্ঘ খরার কারণে চাদে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত। আঞ্চলিক সংঘাতের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীরা দেশটির খাদ্যাভাবকে আরো প্রকট করে তুলেছে। প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে সিয়েরালিয়নে অনাহারী ভুখানাঙ্গা মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার দেশটিতে। দীর্ঘ এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধই দুর্ভিক্ষের কারণ। তীব্র খরাই মাদাগাস্কার খাদ্যাভাবের মূল কারণ। দেশটিতে ১.৪ মিলিয়ন মানুষ অনহারের শিকার। দেশটির অর্ধেক শিশু অনাহার-অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ৫ বছর বয়সের নিচের অর্থেক শিশু খর্বাকার। জাম্বিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ অনাহারে ভুগছে। সেখানে শতকরা ৫০ ভাগ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে খর্বাকৃতি। ইয়েমেনে দীর্ঘ এক দশকব্যাপী যুদ্ধের কারণে ১৭ মিলিয়ন মানুষ অনাহার অভিশাপের শিকার। সুদানেও একই কারণে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার। এ ছাড়া দক্ষিণ সুদান থেকে আসা শরণার্থীরা এ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। লাইবেরিয়ার শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাদের প্রায় সবাই অনাহারে দিন কাটায়- এর প্রধান কারণ ইবোলার প্রাদুর্ভাব। পরপর কয়েক বছর ধরে খরার কারণে নাইজারে ১.৫ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের শিকার। তিমুর-লেস্তে ১ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি ক্ষুদ্র দেশ। দেশটির প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ ক্ষুধার শিকার এবং শতকরা ৫০ ভাগ শিশু খর্বাকার।

বৈশ্বিক অনাহার সূচক-২০১৭ অনুসারে পাঁচ বছরের নিচের বয়সের শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগ শিশুর মৃত্যু ঘটে অপুষ্টিজনিত কারণে। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি লোক অপুষ্টিতে ভুগছে। গত ১০ বছরে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭ লাখ। দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্থ’লতার প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে দেশে শিশু ও নারীর পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বখাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এই তথ্য পাওয়া যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘের কৃষি উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইফাদ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করে। বলা হয় ২০০৪ সালে বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার মানুষ ছিল ২ কোটি ৩৭ লাখ। এখন ২ কোটি ৪৪ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। ১০ বছর আগে এটি ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। অপুষ্টির শিকার মানুষের মোট সংখ্যা বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে তা কমেছে। ভারতে অপুষ্টির শিকার মানুষের হার ২০০৬ সালে ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে কমে ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপও মিয়ানমারের অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের হার কমছে বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুতগতিতে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে বিশ্বে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৭৭ লাখ থেকে বেড়ে ৮ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে একুশ শতকে পৃথিবী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বন পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়কমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ। তার মতে, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে একুশ শতক বিশ্ববাসীর জন্য হবে সম্ভাবনার আধার। পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য দূর করে মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলবে। এ জন্য তথ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে উন্নয়নের বাহন হিসেবে ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।

নিতাই চন্দ্র রায় : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App