×

মুক্তচিন্তা

অবসরে রাজনীতি করার খায়েশ সুস্থ রাজনীতির অন্তরায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৩৬ পিএম

 

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই তাকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যায় না, এমন ব্যক্তি-গোষ্ঠীও তাকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে তিনি অতি প্রিয়, আস্থাভাজন একজন অভিভাবক। তার ওপর আস্থা রাখেন।

আপদমস্তক তিনি একজন অকপট সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ ও সহজ। মফস্বলে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। যতদূর জেনেছি ৪৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি একবারও সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হননি। অর্থাৎ তার ওপর থেকে ভোটাররা আস্থা হারাননি, ভোট দিয়েছেন। এলাকার মানুষের ভালোবাসায় তিনি সিক্ত থেকেছেন, আজো আছেন।

শুধু এলাকা বলছি কেন, আমার বিশ্বাস জন্মেছে, গোটা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই তাকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে যায় না, এমন ব্যক্তি-গোষ্ঠীও তাকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে তিনি অতি প্রিয়, আস্থাভাজন একজন অভিভাবক। তার ওপর আস্থা রাখেন। আজ অবধি তার ভাষায়, চালচলনে অকৃত্রিম রাজনীতির সেই গ্রামীণ ছোঁয়াই রয়ে গেছে। মাটির সোঁদা গন্ধ তার চলনে-বলনে। তিনি বদলে যাননি। বদলে যাওয়ার নির্মম সংস্কৃতিতে তিনি নিজ বৈশিষ্ট্যে অবিকল, অবিচল থেকেছেন।

কিন্তু দেশকে বদলে দিতে স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষকে, তরুণকে। তিনি আর সবার থেকে স্বতন্ত্র থেকেছেন কথা বলায়, ভাবনায়, বিচার-বিবেচনায় তথা সহজ, সরল আচার-আচরণে। রাজনৈতিক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর যে আচরণ সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি কিংবা দেখেছি, যেসব আচরণের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত দেখা সাক্ষাৎ, তিনি সেসব আচরণের ঊর্ধ্বে অবস্থান নিয়েছেন। বলা যায়, থাকতে ভালোবেসেছেন। থেকেও গেছেন। ফলে নেতিবাচক ভাবনার বাইরে তার অবস্থান বরাবরই দৃশ্যমান থেকেছে। এখানেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি অনন্য, স্বতন্ত্র। অকৃত্রিম নিজ বৈশিষ্ট্যের বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। যেটুকু জেনেছি, দেখছি, তাতে বলা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সফল রাজনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত, জনপ্রিয় একজন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আমি তার কথাই বলছি।

ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের প্রায়শ রাজনীতিবিদদের কথায়, আচরণে যেখানে সাধারণ জনগণের মনে বিরক্তি, সংশয়, ক্ষোভ আর হতাশার জন্ম দেয়, সেখানে একজন আবদুল হামিদ জাগরণের গান শোনান। কী আছে তার মধ্যে? সত্য কথা বলার সৎ সাহস। সত্য কথা বলতে পারেন অকপটে। নিজ শিক্ষা কিংবা পারিবারিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে তার যেমন কোনো গোপন প্রচেষ্টা নেই, তিনি বানিয়ে কিছু বলেন না, ঠিক তেমনই সমাজ, রাষ্ট্রে যে অসঙ্গতি প্রত্যক্ষ করেন, তা রাখঢাক না করে অকপটে বলে ফেলেন। সহজভাবে খুব কঠিন সত্য বলার ক্ষমতা তিনি রাখেন। দ্বিধা, সংকোচ, হীন স্বার্থপরতা কোনো কিছুই তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। পারেনি।

সম্প্রতি তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনের খুব একটা কঠিন সত্য উচ্চারণ করেছেন। যা অনেকেই পারেননি, পারেন না। না পারার কারণ নিজেদের দুর্বলতা। কিংবা স্বার্থপরতা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কোনো দুর্বলতা, স্বার্থপরতা আছে বলে আমার জানা নেই। এই গুণের জন্য কেউ তাকে গালিগালাজ করেন কিনা তাও আমার জানা নেই। অন্তত আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি তেমন একটা কঠিন সত্য বলেছেন, রাজনীতি এখন গরিবের বউ। এই সমাবর্তনে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ২১ হাজার ১১১ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সামনে তিনি এই উপলব্ধির কথা বলেছেন। ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির কথায় পরিষ্কার হয়ে ওঠে বর্তমান রাজনীতির করুণ বেহাল অবস্থা। দেখা যায়, বিভিন্ন পেশাজীবীর বেশকিছু ব্যক্তি অবসর জীবনে রাজনীতিতে সরাসরি ঢোকেন, রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই দলে আছেন সরকারি আমলা থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি জেনারেল, বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, করপোরেট ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ীরা। নানা রকম সুবিধাভোগের পর জীবনের একটা সময়ে এরা রাজনীতিতে ঢোকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন প্রবল। দায়বোধ তার কতটুকু কে জানে।

আবার এই প্রয়োজনীয়তা ও দায়বোধ যতটা না জনগণের জন্য, তার শতগুণ বেশি নিজের জন্য। রাজনীতি করেন এসব ব্যক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসার জন্য, ক্ষমতায় বসতে উদগ্রীব হন। রাজনৈতিক দলগুলোও যেন এদের টার্গেট করে থাকেন। লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভেড়ান। এসব ব্যক্তির অর্থসম্পদ, সামাজিক পরিচিতি ও প্রভাব এতটাই প্রবল যে, রাজনৈতিক দলগুলো এদের কুক্ষিগত করতে চায়, করেও ফেলে। যদিও এরা রাজনৈতিক মনষ্ক নন মোটেও, রাজনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞতাও নেই, চর্চা নেই, নেই শিক্ষা। রাজনীতিবিদ হতে হলে, এসব আবার লাগে নাকি, এমন বিস্ময় নেই তাদের।

ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, চাইলেই রাজনীতিবিদ হওয়া যায়। হচ্ছেনও। চাইলেই রাজনৈতিক দলগুলো ইচ্ছামতো এদের দলে জায়গা দিতে পারেন। পারছেনও। অনেকটা আদান-প্রদানের মতো। কেউ কেউ আবার নেই কাজ তো খই ভাজের মতো অবস্থান করেন। এই যেনতেন ব্যক্তির রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় রাজনীতির গুণগতমান তৈরি হয় না। বাড়ার তো প্রশ্নই নেই।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমি মনে করি। রাজনীতিতে যোগ্য ব্যক্তির অনুপ্রবেশ না ঘটলে, দেশের কল্যাণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার জন্ম নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, দাঁড়াচ্ছে। এই নিবিড় সত্য বুঝতে হবে, দলে যারা প্রকৃত রাজনীতিবিদ আছেন, তাদেরই। দলের নেতৃস্থানীয় কাউকে করতে হলে তার যোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

আবার একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, যেসব তরুণ শিক্ষা অর্জনে উচ্চতর স্তরে যাওয়ার যোগ্যতা রাখছেন না, মেধা নেই, তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন রাজনীতিতে। খুব সহজ সম্পৃক্ত হওয়া যেন। কিছু ক্ষেত্রে পেশি আর দুঃসাহস থাকাটা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মূল যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়।

আবার কোনো একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের প্রতি নিজস্ব বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব হয়তো নেই, কিন্তু আবেগীয় সমর্থন আছে। যা তাকে ওই রাজনৈতিক দলের প্রতি তার অন্ধ সমর্থন তৈরি করছে। ভালোমন্দ বিচার শক্তি থাকে না। এরা দলের জন্যই রাজনীতি করেন, দেশের জন্য নয়। কারোর কারোর ভেতর তৃণমূল থেকেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে অর্থসম্পদের মালিক বনে যাওয়ার প্রবণতা কিন্তু কম নয়, বরং দিন দিন বাড়ছে। রাজনীতি করছি, অথচ দৈন্যদশায় জীবন করব, তা কী হয়। এই মনোবৃত্তিতে অতীতে যেমন অনেকে বিত্তশালী হয়েছেন, বর্তমানেও হচ্ছেন।

সম্প্রতি আরো একটি অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসন্ন নির্বাচনে গরিবের টাকা মেরে খাওয়া লোকদের ভোট দিতে জনগণকে নিরুৎসাহিত করেছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি সব দল থেকে ভালো মানুষটিকে বেছে নিতেই আহ্বান জানিয়েছেন। সাধারণত দুর্নীতি, গরিবের টাকা মেরে খাওয়া, অনিয়ম, অপরাধ সংঘটিত করতে ক্ষমতা লাগে। আর তাই বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে কেউ কেউ এসব কাজ করার দুঃসাহস করেন। বিত্তশালী হন। রাজনৈতিক অঙ্গনে সৎ মানুষও আছেন। আছেন যোগ্য ব্যক্তি। পুরোটাই সৎ রাজনৈতিক মনস্ক ব্যক্তি হওয়ায় তাদের বিত্ত নেই। সন্ধান পাওয়া যায় না। এরা পেছনে থাকেন। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চার চাইতে দেশের মানুষের কথা ভাবেন বলে দল এদের কথা সম্ভবত বেশি ভাবেন না। ভাবার সময় পান না। যাই হোক এটা পরিষ্কার যে, টেকসই উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার।

আর সেটা সম্ভব প্রকৃত জনমুখী রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রপতির বিস্ময়, এক সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে যেসব পুলিশের নেতৃত্বে তাদের পাছায় আঘাত করা হয়েছে, সেসব পুলিশও রাজনীতিতে ঢুকে তাদের সঙ্গে রাজনীতি করতে চান! রাজনীতি করছেনও।

পরিশেষে বলি, আদর্শিক স্থিরতা জরুরি রাজনীতিতে। যেটা সম্ভব শিক্ষা, চর্চা ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ থেকে। যে কেউ রাজনীতিবিদ হবেন যে কোনো সময়ে, এই সংস্কৃতি পরিহার করতে না পারলে রাজনীতি মঙ্গল বারতা বয়ে আনবে না, আনার কথা নয়।

স্বপ্না রেজা : উন্নয়নকর্মী ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App