×

মুক্তচিন্তা

কাছের দেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:০৯ পিএম

পিছনের কারণটি শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। শহর কর্তৃপক্ষ কখনোই চায় না যে শহরটি বড়লোকের এলাকা এবং গরিবের এলাকা হিসেবে ভাগ হয়ে যাক। সব মানুষ সমান এবং সবাই মিলেমিশে থাকবে সেটাই হচ্ছে লক্ষ্য! সে জন্য বড় লোকের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাশে গরিবের এপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করতে হয়! আমার তখন হঠাৎ করে মহাখালী ডিওএইচএসের কথা মনে পড়ল, এর ঢোকার পথে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘টোকাই প্রবেশ নিষেধ!’

সাদাসিধে কথা

দেশে থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, এখন দেশের বাইরে গেলে কেমন যেন অস্থির লাগে, মনে হয় কখন আবার দেশে ফিরে যাব! বাংলাদেশের একটা টিমের সঙ্গে একেবারে সবচেয়ে কাছের দেশ ভারতবর্ষে এসেছি, শহরটির নাম পুনে ঝকঝকে তকতকে একটা শহর। থাকা-খাওয়া এবং কাজকর্মের আয়োজন চমৎকার, যারা সঙ্গে আছে তারা সবাই আমার মতো বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাই চমৎকার সময় কাটছে তারপরও মনে হচ্ছে কখন দেশে ফিরে যাব।

আজকে একটু বেশি ব্যস্ততা ছিল তাই দুপুরে ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকেছি। অন্য খাবারের সঙ্গে সফট ড্রিংক অর্ডার দেয়া হয়েছে। গ্লাসে সে করে সফট ড্রিংক ভাঙা হয়েছে এবং তখন লক্ষ করলাম ড্রিংক খাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের স্ট্র নেই, এরকমটি আগে দেখিনি। প্রথমে ভেবেছি বুঝি ভুল করে দেয়া হয়নি কিন্তু একটু পরেই জানতে পারলাম আসলেই সফট ড্রিংক খাওয়ার জন্য এখানে কোনো স্ট্র দেয়া হয় না। কারণটা খুবই চমৎকার। এই রাজ্যটি বুঝতে পেরেছে প্লাস্টিক পলিথিন এই বিষয়গুলো পরিবেশের জন্য একটা বিপজ্জনক বিষয়। পরিবেশ রক্ষা করতে হলে এগুলোর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কাজেই তারা আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে, কেউ আর পলিথিন কিংবা প্লাস্টিক ব্যবহার করতে পারে না। সফট ড্রিংক খাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের স্ট্র পর্যন্ত পাওয়া যায় না। স্থানীয় মানুষদের কাছে শুনেছি কেউ যদি পলিথিনের ব্যাগে কিছু ভরে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে তাদের নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। দেশ থেকে আসার সময় ভুল করে কোনো পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসেছি কী না সেটা নিয়ে এখন খুব দুশ্চিন্তায় আছি!

অথচ এই বিষয়টা করার কথা ছিল আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে। শুনেছি বুড়িগঙ্গার তলাটি নাকি পলিথিনের ব্যাগে বোঝাই। নালা-নর্দমা পলিথিন দিয়ে বুঁজে গেছে। এই পলিথিন যে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে তাও নয়, যুগ যুগ ধরে এগুলো পরিবেশের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে বেঁচে থাকবে। আমাদের এত কাছের একটি দেশ যারা কথাবার্তা-চালচলন শিক্ষা-দীক্ষায় হুবহু আমাদের মতো, তারা যদি পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে আমরা কেন পারি না, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না।

আমরা এখানে এসেছি মেধাস্বত্ব (বা ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি সংক্ষেপে আইপি) সম্পর্কে জানতে। সারা পৃথিবীই মেনে নিয়েছে নতুন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। যারা মনে করে এটা একটা রূপক বা বিমূর্ত কথা তারা যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে তাহলেই বুঝতে পারবে যে এটি আসলে একেবারে টাকা পয়সা বা ডলারের হিসাব হতে পারে। গবেষণা করে যখন কিছু আবিষ্কার করা হয় সেটা যদি পৃথিবীতে ব্যবহার করার উপযোগী কিছু হয় এবং যদি পেটেন্ট করে তার মেধাস্বত্ব রক্ষা করা হয় তাহলে এটা দেশের আয়ের উৎস হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষে এই মেধাস্বত্ব রক্ষা করার ব্যাপারটি খুব গুরুত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে এবং যে মানুষটি প্রথম এই বিষয়টা শুরু করেছেন তার নাম আর এ মাশেলকার। বিজ্ঞানের জগতে সুপারস্টার বলে যদি কিছু থাকে তাহলে মাশেলকার হচ্ছেন সে রকম একজন মানুষ। অল্প বয়সে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার অশিক্ষিত মা অনেক কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছেন। মাশেলকার তার পিএইচডি শেষ করার পরও তার মা নিশ্চিত ছিলেন না তিনি তার সন্তানকে ঠিক করে মানুষ করতে পেরেছেন কি না! দেখতে দেখতে মাশেলকার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলেন, পৃথিবীর সেরা সেরা ইউনিভার্সিটি তাকে ডেকে ডেকে নিয়ে সম্মানসূচক পিএইচডি দিতে শুরু করল। যখন তার সম্মানসূচক পিএইচডির সংখ্যা পঁচিশে দাঁড়াল তখন তার মা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হলেন যে তিনি তার ছেলেকে মানুষ করাতে পেরেছেন! তার বর্তমান পিএইচডির সংখ্যা কত জানার জন্য তার একজন সহযোগীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভদ্রলোক মাথা চুলকে বললেন, ‘শেষবার যখন এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখন তার সংখ্যা ছিল ঊনচল্লিশ, আমি যতদূর খবর পেয়েছি তিনি এর মাঝে আরো একটি পেয়ে গেছেন!’ এই হচ্ছেন মাশেলকার।

বলাই বাহুল্য আর এ মাশেলকার খুব ব্যস্ত থাকেন, দেশে-বিদেশে ঘুরতে হয় তারপরও আমাদের টিমের জন্য সময় বের করে এনেছেন। আমি আগেও লক্ষ করেছি আমাদের দেশের জন্য এক ধরনের মায়া আছে। সেদিন বিকেলেই তার প্যারিস যাওয়ার কথা কিন্তু তার মাঝেই তিনি আমাদের তিন ঘণ্টা সময় দিলেন, একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন। তার কথা বলার ভঙ্গি খুব সুন্দর, খুব চমৎকারভাবে মানুষদের অনুপ্রাণীত করতে পারেন। পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে নিজেদের উপস্থাপন করতে হয় সেটা কখনো ভুলেন না। পশ্চিমা দেশ বহুদিন থেকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আছে কাজেই বড় বড় ব্যাঙের লাফ (Frog leap) দিয়ে তাদের ধরতে হবে এ রকম একটা আলোচনা হয়। আর এ মাশেলকার সেটা শুনে মাথা নেড়ে বলেছেন, ‘উহু’, ব্যাঙের লাফ দিয়ে হবে না, আমাদের পোল ভল্ট করে তাদের ধরে ফেলতে হবে।’ শুধু যে মুখে এ কথা বলেন তা না, আসলেই দেশটি যেন পোল ভল্টের লাফ দিয়ে পশ্চিমা জগৎকে ধরে ফেলতে পারেন সে জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

যাই হোক খুব বড় বড় জ্ঞানী-গুণী মানুষের সঙ্গে আসলে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না, যদি পেয়ে যাই তাহলে তাদের চিন্তার জগৎটি পরীক্ষা করে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। মনে আছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে একবার কার্নেগি মিলান ইউনিভার্সিটিতে হার্বাট সাইমনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমরা সবাই এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কথাটার সঙ্গে পরিচিত, এই কথাটা প্রথম হার্বাট সাইমন ব্যবহার করেছিলন। তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কথা বললেই বোঝা যায় মানুষটা কত অসাধারণ বুদ্ধিমান। তখন মাত্র ইন্টারনেট ই-মেইল আসতে শুরু করেছে, আমার মনে আছে হার্বাট সাইমন তখনই সেটা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলেন। একেবারে ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজেকে এইসব থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন! তার ভাষায়, যখন আমার প্রয়োজন হয় তখন আমি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করব, সবাই ঢালাওভাবে না চাইতেই আমাকে দুনিয়ার খবর দিয়ে ভারাক্রান্ত করে ফেলবে আমি তাতে রাজি নই। আমার তখন বয়স কম ছিল, আমি গলার রগ ফুলিয়ে তার সঙ্গে তর্ক করেছিলাম, সময় মতো খবর পাওয়া যে কত জরুরি সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। তিনি আমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দেননি! এতদিন পর আমি আবিষ্কার করেছি যে, আসলে যে বিষয়টা বুঝতে আমার তিরিশ বছর লেগেছে তিনি সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন।

এখানেও এভাবে মাশেলকারের মতো মানুষকে পেয়ে গিয়ে আমার প্রশ্নের শেষ ছিল না, তিনি ধৈর্য ধরে উত্তর দিয়েছেন! আমি প্রথমেই জানতে চাইলাম, জীবনে ব্যর্থতা সম্পর্কে তার কী ধারণা। আমরা যখনই পিছনে ফিরে তাকাই সব সময়ই দেখি জীবনে যতটুকু সাফল্য ব্যর্থতা তার থেকে অনেক বেশি। মাশেলকার ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা বলতেই রাজি নন, তার মতে এটা হচ্ছে কোনো কিছু জানার প্রক্রিয়া, (FALL হচ্ছে First A Hept In Leaving) বাক্যটার শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর!) আমি তারপর জানতে চাইলাম তাকে কখনো অসৎ মানুষ বা দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের পাল্লায় পড়তে হয়েছে কী না, তিনি বললেন যে, হ্যাঁ। মানুষজন তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। আগে ঢালাওভাবে সবাইকে বিশ্বাস করতেন এখন খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিশ্বাস করেন। আমি জানতে চাইলাম তাকে কেউ হিংসা করে কী না, তার পিছনে কেউ লেগেছে কী না। মাশেলকার বললেন যে, হ্যাঁ, তার বিরুদ্ধে মানুষজন অনেকবার লেগেছে বড় বড় খবরের কাগজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন প্রচারণা চালিয়ে গেছে। তারপর যেটা বলেছেন সেটা লেখার জন্যই আমি এত কিছু লিখেছি। আর এ মাশেলকার বললেন আমার ভিতরে আসলে একটা ডিলিট (Delete) বাটন আছে, দিনের শেষে ঘুমানোর আগে আমি সেই ডিলিট বাটন চাপ দিয়ে সবকিছু মুছে ফেলে শান্তিতে ঘুমাই। কথাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমাদের মতো মানুষদের যাদের ক্রমাগত চারপাশের মানুষের নেতিবাচক কথা শুনতে হয় তাদের সবার ভেতরে এই ডিলিট বাটন থাকতে হবে যেন আমরা দিনের শেষে চারপাশের সবকিছু অসুন্দর এবং কুৎসিত বিষয় মুছে দিয়ে মহানন্দে শান্তিতে ঘুমাতে পারি!

পুনে শহরের ছোট আরেকটা বিষয়ের কথা বলে শেষ করে দিই। একজন খুব উচ্চবিত্ত মানুষের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যেবেলা বাইরে তার সঙ্গে হাঁটছি তিনি আশপাশে সবকিছু দেখাতে দেখাতে তার বিশাল এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাশে আরেকটি উঁচু দালান দেখালেন। বললেন, ‘যারা আমাদের কমপ্লেক্সটি তৈরি করেছে তাদের এই দালালটাও তৈরি করতে হয়েছে, এটি স্বল্প মূল্যের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষরা এখানে থাকবে। শুধু তাই না এর অর্ধেক এপার্টমেন্ট করপোরেশন নিয়ে নিয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করার জন্য।’

এর পিছনের কারণটি শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। শহর কর্তৃপক্ষ কখনোই চায় না যে শহরটি বড়লোকের এলাকা এবং গরিবের এলাকা হিসেবে ভাগ হয়ে যাক। সব মানুষ সমান এবং সবাই মিলেমিশে থাকবে সেটাই হচ্ছে লক্ষ্য! সে জন্য বড় লোকের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাশে গরিবের এপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করতে হয়!

আমার তখন হঠাৎ করে মহাখালী ডিওএইচএসের কথা মনে পড়ল, এর ঢোকার পথে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘টোকাই প্রবেশ নিষেধ!’ একটা স্বাধীন দেশে সত্যিই কী আমি দরিদ্র শিশুদের একটা এলাকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিতে পারি? একেবারে ঘোষণা দিয়ে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App