সংসার চলছে চা বিক্রি ও নির্মাণ শ্রমের টাকায়
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৩:১৩ পিএম
সারা দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে দিন শেষে মজুরি মিলত ৩শ টাকা। তাও আবার ইট টানা, পানি টানা, বালি, সিমেন্ট, খোয়া মেশানোর কাজ। কখনো দ্বিতীয়, কখনো তৃতীয় তলার সিঁড়ি বেয়ে জোগালির কাজ করেছেন। সন্ধ্যায় চাল-ডাল কিনে ফিরতে হতো বাড়িতে। সারা দিন কাজ করে ৩শ টাকা পারিশ্রমিক পেয়ে ৫ সদস্যের পরিবারের সংসার চলত না কামরুলের।
দুবছর আগে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে উপজেলা শহরের খাদ্যগুদামের পাশে চায়ের দোকান শুরু করেন। সঙ্গে বিস্কুট, কলাসহ মুদি সামগ্রী বিক্রি করে যা উপার্জন হতো তাই দিয়ে কিছু দিন বেশ ভালোই চলছিল কামরুলের সংসার। কিন্তু এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সম্প্রতি তার দোকানের বেহাল অবস্থা দাঁড়িয়েছে। ৬ মাস ব্যবসা চালাতে চায়ের দোকানেই তার বাকি পড়ে ৬০ হাজার টাকা। পাওনা টাকা চাইতে গেলে অধিকাংশ সময় দেনাদারের ধমক খেয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে।
জানা যায়, গত সোমবার চায়ের পাতি কিনতে না পেরে দোকান খুলতে পারেননি তিনি। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একজন এনজিও কর্মী কিস্তির টাকা নিতে দাঁড়িয়ে আছেন দোকানের সামনে। অবশেষে তার বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার কাছ থেকে জানা যায়, এনজিওর কিস্তির টাকা জোগাড় করতে না পারায় আজ দোকান না খুলে শ্রমিকের কাজে গেছেন তিনি। কামরুল হাসানের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামে।
কামরুল হাসান ২০০২ সালে এসএসসি পাস করে মহম্মদপুর আমিনুর রহমান কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাহসিকতা দেখে দলীয় নেতারা ২০০৪ সালে মহম্মদপুর আমিনুর রহমান কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মনোনীত করেন তাকে। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। সভাপতি মনোনীত হওয়ার পর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তিনি। ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করেন কামরুল। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি। অভাব মোচন করতে চাকরির জন্য ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থ এবং তদবিরের অভাবে সোনার হরিণ নামের চাকরি তার ভাগ্যে জোটেনি। স্ত্রীর চাকরির জন্যও অনেক চেষ্টা করে চাকরি মেলাতে পারেননি। তার স্ত্রী রেহেনা বেগমও এইসএসসি পাস। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। উপায়ন্তর না দেখে কামরুল পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। সেই উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে বর্তমানে তিনি চা বিক্রি করছেন। কামরুলের ছাত্র জীবনের সেই রাজনৈতিক সংগ্রাম আর বর্তমান সময়ের জীবন সংগ্রামের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। মধুমতি নদীর করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে তার পরিবারটি এখন নদী তীরবর্তী এলাকায় ৪ শতাংশ জমির ওপর বসবাস করছে। এ ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই তার। অসুস্থ বাবা মুসা মিয়া শয্যাশায়ী, মা জোবেদা বয়সের ভাবে ভারাক্রান্ত। স্ত্রী রেহেনা গৃহস্থালির কাজকর্ম করেন। তাদের ঘরে ৮ বছরের রোমান নামের শারীরিক প্রতিবন্ধী অসুস্থ একটি সন্তান রয়েছে। তার চিকিৎসা দিতে মাসে খরচ হয় দুই হাজার টাকার বেশি। সব মিলিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কামরুল এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অর্থাভাবে অসুস্থ বাবা এবং প্রতিবন্ধী সন্তানের চিকিৎসা খরচ চালাতে পারছেন না।
কামরুল তার স্বপ্নের কথা, ইচ্ছের কথা জানান। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষে চাকরি করে সংসারের অভাব মোচন করবেন। কিন্তু তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। অশ্রুভেজা চোখে তিনি বলেন, টাকার অভাবে চায়ের দোকানটিও এখন চালাতে পারছি না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দোকান শুরু করেছিলেন তিনি। দোকানে মালামাল না থাকায় আগের মতো বেচা-বিক্রি নেই। বাধ্য হয়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দিয়েছেন।
মহম্মদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বয়ক মামুনুর রশীদ বিপ্লব বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামরুল কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসেননি। তবে শিগগিরই মিটিং ডেকে তার জন্য কিছু করার চেষ্টা করব। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, আমি তার দুরবস্থার খবর জানতে পেরেছি। এত দিন দলীয়ভাবে তার জন্য কিছু করা উচিত ছিল। তা হয়নি। তবে দলীয়ভাবে মতবিনিময় করে দ্রুত তার জন্য কিছু করার উদ্যোগ গ্রহণ করব।