×

জাতীয়

ভেঙে পড়েছে নড়িয়ার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১৮ পিএম

ভেঙে পড়েছে নড়িয়ার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা
শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙনকবলিত এলাকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফসলি জমি, বসতবাড়িসহ পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি স্কুল ও হাসপাতাল। ফলে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি সীমিত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নেয়ায় শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয় বিমুখ হচ্ছে। নড়িয়া উপজেলার ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাংশ এখন পদ্মার পেটে। মূল ভবনটিও হেলে গিয়ে অপেক্ষায় আছে পদ্মায় বিলীন হওয়ার। পাশের পুরাতন ভবনটিতেও ফাটল ধরেছে। ইতোমধ্যে এসব ভবন থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সব কিছু। ভাঙন আতঙ্কে চিকিৎসক ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরাও চলে গেছেন অন্যত্র। বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের জন্য নির্মিত আবাসিক ভবনগুলোতে চলছে চিকিৎসা সেবার কাজ। পুরাতন পরিত্যক্ত একটি ভবনে করা হয়েছে হাসপাতালের আন্তঃবিভাগ। সেই ভবনটিতেও বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরো ১২টি ভবনও ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া লাইফ কেয়ার হাসপাতাল, দেওয়ান ক্লিনিক ও ডেলটা ক্লিনিক নামের তিনটি বেসরকারি ক্লিনিক ভবন নদীতে বিলীন হয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স সুজাতা বাড়ৈ বলেন, গত ২০ বছর ধরে আমি এই হাসপাতালে কাজ করছি। এমন ভাঙন দেখিনি। এখন তো আমরা নদীর মধ্যে ভাসছি। আগে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী হতো। এখন এর সংখ্যা দুই-তিন জনে নেমে এসেছে। আমরা কি করব বলেন? রোগীরা ভয়ে হাসপাতাল আসতে চায় না। থাকতে চায় না। তবে বহির্বিভাগে এখনো কিছু রোগী আসে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. খলিলুর রহমান বলেন, নদী ভাঙনের ফলে পুরো হাসপাতাল ক্যাম্পাসই ঝুঁকির মধ্যে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসপাতালের কার্যক্রম আবাসিক ভবনে নিয়ে আসি। জনগণের দাবি ছিল নতুন ভবন না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম অন্যত্র সরানো যাবে না। রোগীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে হাসপাতালের পেছনে দেয়াল ভেঙে রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আম্বিয়া বেগম (৫৫)। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িঘর নদীতে গেছে। আমারেও অসুখে ধরলো। মাইয়াডা আমারে হাসপাতাল ভর্তি করাইছে। কিন্তু এখানে থাকতে ডর করে। রাইতে ঘুমাইতে পারি না। মনে হয় নদীতে তলায়ে যামু।’ খেলতে গিয়ে থুতনি কেটে গেছে মার্জিয়া বেগমের (৩০) তিন বছর বয়সী ছেলের। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি। নদী ভাঙনে এলাকা ছাড়া মার্জিয়া বলেন, শরীয়তপুরের মধ্যে সব থেকে বেশি উন্নত ছিল এই নড়িয়া। আজ তার এই দুরাবস্থা। কিনা ছিল এই নড়িয়াতে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্কুল, কত্ত বড় বড় বিল্ডিং। আজ সবই অতীত। এদিকে দীর্ঘদিনের নদী ভাঙনে উপজেলার প্রায় ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হলেও শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে পড়ছে। যারা এখনো বিদ্যালয়ে আসছে তারাও রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাস করছে খোলা আকাশের নিচে। তবে উপস্থিতির হার অনেকটাই কম। অনেকে ভয়ে স্কুলে আসতে চায় না। শেহের আলী মাদবরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামছুন নাহার বলেন, আমাদের স্কুলটি এ পর্যন্ত দুইবার নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। ২০১৭ সালে যখন প্রথমবার নদী ভাঙে তখনই বিদ্যালয়ের পাকা ভবনসহ সব কিছু নদীগর্ভে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে আমরা জিল্লু খালাসীর গাছের বাগানে আশ্রয় নেই। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আট মাস ক্লাস করেছি। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও মালামাল এলাকার মানুষের ঘরে রেখেছিলাম। কিছুদিন পর সেই জায়গাটিও নদীগর্ভে চলে যায়। এরপর আমরা শেহের আলী মাদবরকান্দির ইউনুছ শেখের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়ে সেই বাড়ির উঠানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করি। সেখানেও নানা সমস্যা হয়। পরে আমরা কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে ইউনুছ শেখের কাঠবাগানে এসে মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের এলজিএসপি প্রকল্পের সহায়তায় তিন রুম বিশিষ্ট একটি দো-চালা টিনের ঘর তুলি। বর্তমানে একটি রুমে ক্লাস করানো যায়। আর বাকিদের খোলা আকাশের নিচে বাগানে রোদের মধ্যে ক্লাস করাই। এই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আইরিন আক্তার বলেন, আমাদের বাড়িও নদীতে গেছে। স্কুলও নদীতে গেছে। এখন আমরা অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকি। সেখান থেকে স্কুল অনেক দূর। তারপরও অনেক কষ্ট করে স্কুলে আসি। কারণ সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। এখানে আমরা খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে ক্লাস করি। পূর্ব নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসমা আক্তার বলেন, গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে স্কুলটি ভেঙে যায়। এরপর আমরা স্কুলটি পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. দুলাল বেপারির বাড়িতে স্থানান্তর করি। প্রথমে বাড়ির উঠানে ক্লাস নিলেও এখন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একটি গোডাউনে বাচ্চাদের দুই শিফটে ক্লাস নিচ্ছি। স্কুলটি আগের জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে আসায় শিক্ষার্থীদের ট্রলার দিয়ে আসতে হয়। এ জন্য অনেক অভিভাবক ঝুঁকি নিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একেবারেই আসে না। বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বলেন, আমাদের স্কুল অনেক সুন্দর ছিল। ফ্যান, টিউবওয়েল, টয়লেট ও পাকা বিল্ডিংসহ সব কিছুই ছিল। গোডাউনে অনেক গরম। আমাদের পড়াশোনা করতে খুব কষ্ট হয়। মা-বাবাও ভয়ে আমাকে স্কুলে আসতে দিতে চায় না। অন্যদিকে চর জুজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ঐতিহ্যবাহী মূলফৎগঞ্জ মাদ্রাসা স্কুলে নিয়ে দুই শিফটে ক্লাস করানো হচ্ছে। স্কুলের সহকারী শিক্ষক নেইলি আফরোজ বলেন, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে। ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App