×

জাতীয়

টনক নড়েছে সর্বনাশের পর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০১:৪০ পিএম

টনক নড়েছে সর্বনাশের পর
পদ্মার ভাঙন থেকে নড়িয়া ও কেদারপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা রক্ষার দাবিতে এলাকাবাসী প্রথম আন্দোলন করেন ২০০৯ সালে। এরপর বিভিন্ন সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য এমন কি মন্ত্রণালয়ের কাছেও এই দাবি জানিয়ে আবেদন করেছিলেন এলাকাবাসী। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তাদের সেই দাবির কথা কেউ কানে তোলেনি। চলতি বছর জুন মাস থেকে পদ্মার ভাঙন যখন তীব্র হয় তখনও টনক নড়েনি প্রশাসনের। ইউএনও থেকে শুরু করে মন্ত্রী সবাই যেন ছিলেন ঘুমের ঘোরে। আর এখন সর্বগ্রাসী পদ্মার ভয়াবহ রূপ দেখে তোড়জোড় শুরু হয়েছে সবার। এ নিয়েই আক্ষেপ এলাকাবাসীর। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা ভোরের কাগজকে বলেন, বাঁধ রক্ষার দাবিতে আমরা যখন প্রশাসনের লোকের কাছে গিয়ে ধর্ণা দিতাম তখন তারা কেউ আমাদের কথা শোনেনি। আমরা নিঃস্ব হওয়ার পর তাদের হুঁশ হয়েছে। এখন নদীভাঙন দেখতে মন্ত্রী, এমপি আসে। তারা যদি আগে আসত তাহলে আমাদের এই দুর্দশা হয় না। প্রমত্তা পদ্মা এখন অনেকটাই শান্ত। তবে ফাটল ধরা ভবনগুলো প্রতিদিনই একটু একটু করে ভাঙছে আর নদীতে বিলীন হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকালেও নড়িয়ার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (নতুন ভবন) হেলেপড়া ভবনের কিছুটা অংশ ভেঙে পড়ে পদ্মায়। মঙ্গলবার পূর্ব কেদারপুরের জব্বর খাঁর হেলেপড়া বসতবাড়িটিও ভেঙে পড়ে। ভাঙনে তলিয়ে যাওয়ার আগে টিনের ঘর, জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয়রা। যাদের পাকা ভবন তারা লোক দিয়ে সেই ভবনও ভাঙছেন। নিঃস্ব পিঞ্জর আলী সোহেল বলেন, ‘পাঁচ বছর ধইরাই এ অঞ্চল পদ্মায় ভাঙতাছে। তবে এমন ভয়াবহ ভাঙন নড়িয়ার মানুষ কখনো দেখে নাই। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ভিটামাটি হারা হচ্ছে। সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ভাঙনের সময় কিছু চাল-ডাল সহায়তা দেয়, কিন্তু বাঁধ দেয় না।’ নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান বলেন, নড়িয়া এলাকায় প্রথম ভাঙন দেখা দেয় ১৯৯৬ সালে। আজ যেখানে পদ্মা নদী, তারও পাঁচ ছয় কিলোমিটার ভেতরে এক সময় জমি ছিল। ২০০৯ সালে আমরা নদীশাসনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা রক্ষার দাবিতে প্রথম আন্দোলন করি। ২০১২ সালের দিকে দুই কিলোমিটার জায়গা বালির বস্তা দিয়ে অস্থায়ীভাবে নদীকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। গত বছর থেকে নদী যেন উত্তাল হয়ে সব গ্রাস করতে চাইছিল। ভাঙন শুরু হলো। তখনো তেমন কিছু করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর থেকে কুণ্ডেশ্বর পর্যন্ত প্রায় নয় কিলোমিটার জায়গা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ এবং নদীর মধ্যখানে একটি চ্যানেল কেটে পানি, অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী একনেকে একটি প্রকল্প পাস করে দিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কাজই শুরু হয়নি। নড়িয়া পৌরসভার মেয়র শহীদুল ইসলাম বাবু রাড়ি বলেন, ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছি। গণঅনশন করেছি, ঢাকায় গিয়ে কর্মসূচি পালন করেছি। কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে কিন্তু নানা জটিলতায় এখনো কাজ শুরু হয়নি। নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, এলাকার জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি দেই। জেলা প্রশাসক ১৬ এপ্রিল সেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের দাবি করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। এদিকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামকে বদলি করা হয়েছে। তার স্থলাভিসিক্ত হয়েছেন প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার। তিনি ভোরের কাগজে জানান, নদীভাঙন এবং ভাঙন প্রতিরোধের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্যদিকে বাঁধ নির্মাণ ও ড্রেজিংয়ের কাজে বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী। তিনটি ড্রেজিং মেশিন আসার কাথা থাকলেও গতকাল পর্যন্ত একটি ড্রেজিং মেশিন এলাকায় পৌঁছেছে। এ নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে এলাকাবাসীর মনে। বাঁধ নির্মাণের আগে বিআইডবিøউটিএ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের দশ সদস্যবিশিষ্ট একটি দল জরিপ কাজ পরিচালনা করছে। জরিপ দলের সমন্বয়ক হাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার থেকে তারা জরিপ কাজ শুরু করেছেন। জরিপ সম্পন্ন হলে তারা জরিপ প্রতিবেদন জমা দেবেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। এরপর ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড শরীয়তপুর কার্যালয় ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এ বছর জুন মাস থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়ায় ভাঙন শুরু হয়। জুলাইর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। থেমে থেমে ভাঙন হচ্ছে। ভাঙনে নড়িয়া পৌরসভার চরনড়িয়া, বাঁশতলা, পূর্বনড়িয়া, কেদারপুর ইউনিয়নের চরজুজিরা, সাহেবের চর, বসাকের চর ও কেদারপুর গ্রাম সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। বাঁশতলা বাজার, সাধুর বাজার, ওয়াপদা বাজার সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। নড়িয়ায় তিনটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডের কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সীমানা প্রাচীর, মসজিদ ও গাড়ি রাখার গ্যারেজ বিলীন হয়ে গেছে। হাসপাতালের মূল ভবনটি পদ্মায় ধসে পড়েছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরো ১১টি ভবন। ভাঙনের কারণে মুলফৎগঞ্জ বাজারের তিন শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়েছে। পদ্মার গহবরে হারিয়ে গেছে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের ৩ কিলোমিটার এলাকা। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে মুলফৎগঞ্জ বাজারের দেড় হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নড়িয়া উপজেলা সদরের প্রায় দুইশ মিটারের মধ্যে রয়েছে পদ্মা নদী। এ কারণে উপজেলা সদরের সরকারি-বেসরকারি দুই হাজার প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার স্থাপনাও ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। গত ৭ আগস্ট সাধুর বাজার লঞ্চঘাটে ২০০ মিটার জায়গা ধসে আট ব্যক্তি নিখোঁজ হন। এ ছাড়া গত চার বছরে ভাঙনের কারণে মাটি ধসে নিখোঁজ রয়েছেন ৩৮ ব্যক্তি। এদের মধ্যে ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App